জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর এক মহেন্দ্রক্ষণ পার করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একটি দেশ ও জাতির জন্য অর্ধ শতাব্দি খুব একটা কম সময় নয়। তারপরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী রাজাকার, আলবদর, আল সামস ও পিস কমিটির বেঈমান বিশ^াসঘাতকদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রনয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। বহুল বির্তকিত প্রকাশিত তালিকাটি সংশোধিত করে রজত জয়ন্তীতে প্রকাশের কথা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক হলেও সত্য আমরা জাতির শেষ্ঠ সন্তানদের সঠিক গ্রহণযোগ্য একটি তালিকা প্রনয়ন করতে পারিনি।বারবার উদ্যোগ নিলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।
১৯৭২ সালে জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যাক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যে কোনো সংগঠিত দলের সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সে হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষরযুক্ত সনদ যাদের কাছে ছিল, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স¦ীকৃতি পেয়েছেন। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল কিছুটা ইনফরমাল। ইনফরমাল যুদ্ধের সমস্যা হচ্ছে সেখানে রেকর্ড বড় বিষয় থাকে না। এমন কি ক্যাম্পে গিয়ে কতজন ছিল, তার কিছুটা বলতে পারলেও পুরোটা বলা সম্ভব হয় না। তাছাড়া রাজনৈতিক,অথনৈতিক এবং কাঠামোগত কিছু সমস্যার কারণে জাতীয় সর্বকালের শেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না।
এ পর্যন্ত ছ’বার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রনয়ন করা হয়েছে। মুুক্তিযোদ্ধার সংঙ্গা এবং বয়স নির্ধারনও করা হয়েছে। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। দেশ স্বাধীন হবার পর মুুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যাথা কারো ছিল না। তখন সনদ ছিল তবে ভাতা ছিলনা। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টা পুনবিন্যাস করা হয়। সে সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের লোকজনদের নিয়োগের মাধ্যমে রাজনীতিকরন শুরু হয় ১৯৭৭ সালের দিকে। অন্যদিকে হু মোঃ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে নিজে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রনয়নের প্রথম উদ্যোগ নেন। এরপরও সময়ের ব্যাবধানে আরো পাঁচবার তালিকা করা হয়েছ্।ে বিশ্লেষকরা বলেছেন, ২০০৪ সালে সবচেয়ে বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন। প্রথমত: মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। তবে মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের ব্যাপারে যাচাই বাছাই করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারের মত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে।
মূলত: ঘোলা পানিতে রাজনৈতিক মাছ শিকারের কৌশল, আর্থিক সুবিধা পারিপার্শিক সুবিধার জন্যই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা নিয়ে নয়-ছয় করা হয়েছ্।ে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর দেশে ক্রমান্নয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা ও সরকারি চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে মেয়ে এবং পরবর্তিতে নাতি-নাতিরা পর্যন্ত যে কোটা ব্যবস্থা ছিল তার কারণে বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। ২০১৮ সালে পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারি চাকুরীতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার কোটা ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সব ধরনের চাকরী থেকে কোটা পদ্ধতি তুলে দেয়া হয়। তবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও সরকারি মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ আছে। সরকারি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধারা বিনামূল্যে সব ধরনের পরীক্ষা করতে পারেন। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ও আসন পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার। এমনকি চলতি করোনা ভ্যাকশিন গ্রহনের ক্ষেত্রেও তাঁরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এর বাইরে ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা প্রথমে দু’বছর পরে আরো এক বছর বাড়ানো হয়।
২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। এর আগে ছিল ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে দ্ইু ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষের ভাতা পান। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পাচ্ছেন ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। উল্লেখ্য ২০০০ সালের সেক্টেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধদের মাসিক সম্মানী ভাতা দেওয়া শুরু হয়। তখন ভাতা ছিল ৩০০ টাকা। ধাপে ধাপে তা বেড়ে ২০০৮ সালে হয় ৯০০ টাকা ২০১৪ সালে হয় ৫ হাজার টাকা এবং ২০১৬ সালে হয় ১০ হাজার আগামী অল্প কিছুদিনের মধ্যে মাসিক ভাতা ২০ হাজার টাকা করা হলে বলে শোনা যাচ্ছে।
এসব সুযোগ সুবিধার লোভে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে অনিয়ম বেড়ে যায়। অনেকে কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেন। খোদ মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের এক সাবেক সচিবও তা করেন। তবে শেষ রক্ষা তার হয়নি। তার সনদ ভুয়া প্রমানিত হওয়ায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে ভুয়াদের চিহ্নিত করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে যাচাই বাছাই করার ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা, সাথে নানা দূর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
প্রথমে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণকারীদের নামই তালিকায় নেয়ার কথা থাকলেও পরবর্তিতে মুজিব নগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে শিল্পী,সাহিত্যিক ,খেলোয়ার,চিকিৎসক,লেখক,সাংবাদিক এবং দেশ-বিদেশে বিভিন্নভাবে অবদান রাখা ব্যাক্তিরাও তালিকাভুক্ত হন। ২৬ মার্চ প্রকাশিতব্য তালিকায় ২ হাজার ৮৩৪ জনের নাম বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভিন্ন ভিন্ন তালিকা ছিল অর্থাত সামরিক,বেসামরিক তালিকা, ভারতের প্রশিক্ষন প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রনীত মুক্তিবার্তায় অন্তভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা সকলের নাম অন্তভুক্ত করা হয়েছে।
মন্ত্রনালয় স্বীকৃত ৩৩ ধরনের প্রমানকের মধ্যে যে কোন একটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম থাকলে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এম আই এস) নামে যুক্ত করা হয়েছে। দেশ বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা ২ লাখ ৩৩ হাজার। তবে আইনী জটিলতার কারণে ভাতা পেতেন ১ লাখ ৯৩ হাজার। এর মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার নাম এম আই এসে যুক্ত হয়েছে।
জামুক মহাপরিচালক বলেছেন, যাচাই বাছাই শেষে ১৬ হাজার ৬৯১ জনের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তভুিক্তর সুপারিশ এসেছে। আর নাম বাদের সুপারিশ এসেছে ২ হাজার ৮৩৪ জনের। অন্যদিকে মাসিক সম্মানী ও বিভিন্ন ভাতা পাওয়া ১ লাখ ৯৩ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম গত বছরের অক্টোম্বরে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করার পরই হঠাৎ সংখ্যাটি ২১ হাজার কমে যায়। যাদের নাম বাদ পড়েছিল, তাদের গত ফ্রেবরুযারী পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমানসহ নাম অন্তভুিক্তর সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু চার মাস পরও ১৩ হাজার জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকে হয়তো একাধিক নামে নয়তো জাল সনদে এতদিন ভাতা তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন ওই ১৩ হাজার ব্যাক্তিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভবনা আর নেই। তারা বলেছেন, এত বছর তারা যে সুবিধা নিয়েছেন, তাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা এতদিন ভাতা নিয়েছেন, তাদের কাছে টাকা ফেরত চাওয়া হবে সাথে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন আইনি পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এটা আদৌ তোলা সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। সাথে যেসব কর্মকর্তা ও বা নেতার কারণে তারা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন তাদেরও আইনী ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি।
পরিশেষে আমরা মনে করি জাতির বীর সন্তানদের নামের তালিকা নিয়ে বার বার যাচাই বাছাই অসন্মানের। এবার অন্তত: সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি তালিকা জাতি পাক। একজনও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম সেখানে যেন না থাকে। অন্যদিকে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নামও যেন বাদ না পড়ে। ঘোষিত তালিকা থেকে কারো নাম বাদ পড়লে যাতে পরবর্তিতে যাচাই বাছাই করে তা সংযুক্ত করার সুযোগ থাকছে বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক। তেমনি যদি কোন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম যেকোন কারনে সংযুক্ত হলেও তা যেন অপসারন করা যায়। আমরা চাই সব বির্তকে উর্দ্ধে একটি গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা।