বিশ্ববাজারে শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। ওসব পণ্যের মধ্যে তুলা, স্টিল, সিমেন্টের কাঁচামাল, অপরিশোধিত তেল এবং বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রয়েছে। মূলত দুটি কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কাঁচামাল রপ্তানিকারকরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বিপুল পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। যে কোনো মূল্যে এর সমাধান করতে না পারলে দেশে উৎপাদনমুখী দেশীয় শিল্পে আরো বিপর্যয় নেমে আসবে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। শিল্পখাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কল-কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কোনো কোনো পণ্যের দাম গত দু’মাসে প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পণ্যের উৎপাদিত খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। আর বাড়তি দামের কারণে আগে নেয়া রপ্তানির অর্ডারগুলোও উদ্যোক্তাদের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। নেয়া যাচ্ছে না নতুন অর্ডারও। বরং বিদ্যমান অবস্থায় দেশীয় শিল্প-কারখানাগুলোর পক্ষে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বস্ত্র খাত।
সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতিতে ক্রমাগত বাড়ছে শিল্প খাতের অবদান। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্পের অবদান ২৯ শতাংশ। এ খাত কর্মসংস্থানেও সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার অভাবে শিল্প খাতের কাক্সিক্ষত সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে শিল্পে ব্যবহৃত বেশির ভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে ওই কাঁচামালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প খাত বস্ত্র। আর ওই খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলা। গত বছরের শুরুতে কিছুটা তুলার দাম কমতে থাকে। কিন্তু জুলাইয়ের পর তা আবারো বাড়তে থাকে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৬৩ থেকে ৬৩ দশমিক ৩০ সেন্ট। বর্তমানে প্রতি পাউন্ড তুলা ৭৯ থেকে ৮০ দশমিক ২৫ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। ওই হিসাবে তুলার মূল্যবৃদ্ধির হার সাড়ে ২৮ শতাংশের বেশি। মূলত চীনা কারখানার মালিকদের অতিরিক্ত আমদানির কারণে তুলার দাম বেড়ে গেছে। দাম আরো বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় চীনা আমদানিকারকরা এবার অতিরিক্ত তুলা মজুত করেছে। তাছাড়া পাকিস্তান এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশে তুলার উৎপাদন কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়েছে। তুলার দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুতার দামও বেড়েছে। ৩০ কার্ডেড সুতা কয়েক মাস আগে প্রতি কেজি ২ ডলার ৬০ সেন্ট থেকে ২ ডলার ৮০ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন তা ৩ দশমিক ৬০ থেকে ৩ দশমিক ৭৫ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল স্টিলের বাজারও এখন ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী। করোনার সময় চীনের নির্মাণ খাত কিছুটা শ্লথ হলে স্টিলের দাম পড়তে থাকে। কিন্তু বসস্তকালীন ছুটি শেষে চীনা কারখানাগুলো পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যায়। তখন দেশটির স্টিলের পণ্য ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চাহিদাও বাড়তে থাকে। চীনা ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে প্রচুর স্টিল মজুত করেছেন। তাছাড়া চীনা সরকার ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। আর তা বাস্তবায়নে ব্যাপক নির্মাণ কাজ চালু রাখতে হবে। ওই ধারণা সামনে রেখেই ব্যবসায়ীরা স্টিলের মজুত গড়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্টিলের দাম বেড়েছে। একই সময়ে লোহার দামও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লোহার দাম আরো বাড়বে। বর্তমানে প্রতি টন লোহা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ ডলার। সেটি আরো বেড়ে ২০০ ডলারে উন্নীত হতে পারে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও বেড়েছে। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তেলের দাম পড়তির দিকে থাকলেও এখন ঊর্ধ্বমুখী। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরুতে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানির দাম ছিল ৬২ ডলার। অথচ গত জানুয়ারিতে সেটি ছিল ৫৪ ডলার। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক করোনার শুরুতে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তখন অবশ্য চাহিদাও কম ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে চাহিদাও বেড়েছে। তাতে প্রায় প্রতিদিনই ওই কাঁচামালের দাম বাড়ছে। একইভাবে গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারে সংবাদপত্র শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের দামও বেড়েছে। গত তিন মাসে ওই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ।
এদিকে শিল্পের কাঁচামালের অস্বাভাবিক গতিতে মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। তবে এখানে স্বল্প মেয়াদে বেশি কিছু করার নেই। কারণ বিশ্ববাজারের ওপর এদেশের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেক্ষেত্রে যেসব দেশ এমন ধরনের কাঁচামাল রপ্তানি করছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে দরকষাকষির মাধ্যমে দাম কিছুটা কমানো যায় কিনা তা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। তবে মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে কিছু উদ্যোগ নেয়া যায়। যেমন- শিল্পে ব্যবহার হয় এমন কিছু কাঁচামাল দেশেও উৎপাদন করা সম্ভব। সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বাড়াতে সরকারকেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার মেনুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, শিল্পের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছে। বিশেষ করে সুতার দাম অনেক বেশি বেড়ে গেছে। দেড় মাস আগে যে রপ্তানির অর্ডার নেয়া হয়েছিল তখন প্রতি কেজি সুতার দাম ছিল ২ দশমিক ৭ থেকে ৩ ডলার। বর্তমানে ওই সুতার দাম ৪ ডলারের উপরে। তাতে পণ্যের খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা দাম বাড়াচ্ছে না। ফলে তাদের অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। নতুন কোনো অর্ডারও নেয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় উদ্যোক্তাদের কিছু করারও নেই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই। চীনসহ কয়েকটি দেশের দখলে ওই বাজার। তারাই কারসাজি করে কাঁচামালের দাম বাড়াচ্ছে।