জনসেবা, ন্যায়নীতি, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, মানুষের ভালোবাসা এই কথাগুলোর তাৎপর্য যেমন ব্যাপক তেমনি এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষন ও গুরুত্ব অপরিসীম। যার মধ্যে নীহিত রয়েছে দেশ, জাতি, জনগণের প্রতি দরদ, দয়ামায়া ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কথাবার্তা, টেবিলটক, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনায় অনেকের মুখ থেকে এসব ব্যাপারে অনর্গল খই ফুটলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন খুব কমই দৃশ্যমান হয়। আর যারা কথায় ও কাজে এই কথাগুলোর বাস্তবায়ন করে থাকে, তাদেরকে কথার মধ্যে অনর্গল খই ফুটানো তো দূরের কথা নিজেকে যেমন জাহির করে না তেমনি কোনো ব্যাপারে বকবক, ফকফক করতে দেখা যায় না। ওরা কাজের মধ্যেই তা বাস্তবায়িত ও প্রতিফলিত করে থাকে। তাদের কাছে দেশপ্রেম, ন্যায়নীতি, জাতীয়তাবোধ, জনসেবা, জাগ্রত বিবেক, দেশ ও দেশের স্বার্থই বড় বলে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে কর্মদোষে যেমনি অনেকে ছিটকে পড়ে, তেমনি ত্যাগ ও কর্মগুণে নিজেকে সমাজের উচ্চাসনে অনেকেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে। যার উপমা, উদাহরণ, দৃষ্টান্ত ও দৃশ্যপটের শেষ নেই। মানুষ তাদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, সম্মান, শ্রদ্ধা ও সানন্দে গ্রহণ করে থাকে।
অনেকেই বড় আসনে চাকরি করেও স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও পরিবারের ভরন পোষন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়। আবার অনেকেই গাড়ী, বাড়ী, ফ্ল্যাট ব্যবহার করে রাজা ধিরাজের মতো সৌখিন জীবনযাপন করে থাকে। যা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষন ও আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া সমাজ ও কর্মপরিসরে এই সংখ্যা এত বেশি যার বর্ণনা দেয়া বাস্তবিকই অসম্ভব। তারপরও অনেক সময় এ শ্রেণীটার আচার, আচরণ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার (গরংধঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়বিৎ) সহ অনেক সময় অনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনেক কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। প্রায় কয়েক মাস আগে জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক এবং সেই অফিসেরই কর্মরত একজন সহকারিনীর ব্যাপারে মিডিয়া, গণমাধ্যম, ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বেলাল্লাপনা দেশের মানুষ অবলোকন করেছে তা নতুন করে এ নিবন্ধে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যা অনৈতিকতা ও বেলাল্লাপনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগনিত। তারপরও দেশে এমন ধরণের আরও অশ্লীল ও বেলাল্লাপনা ঘটনার সীমা পরিসীমা নেই।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ ব্যাপারে যা মন্তব্য করেছেন, তাতে সিইসি কে.এম নূরুল হুদার ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে ঠাঁই পেয়েছে তা ভাবতে গিয়েও অনেকেই অবাক ও বিষ্ময় প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) সাখাওয়াত হোসেন, ড. শাহদীন মালিকসহ আরও অনেকে যে মন্তব্য করেছেন তা যথেষ্ট লক্ষ্য করার বিষয়।
এদিকে ৮ মার্চ সোমবার সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময় কালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, দায়িত্বকালে পাঁচ বছরে নিজের ওপর অনেক চাপ নিয়েছি। অনেক মন্ত্রী, এমপির তদবির, সুপারিশ শুনিনি। তবে জনগণের আকাংখা দুদক পূরণ করতে পারেনি। জনগণের আস্থা অনুযায়ী কিছুই করতে পারিনি। এগুলো আসলেই হতাশার কথা। এমনিভাবে বিদায়ের আগে সাবেক দুদক চেয়ারম্যান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা প্রধান লেঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মশহুদ চৌধুরী বলে ছিলেন, ও ধস ঁহফড়হব, ঁহধনষব ্ ঁহংঁপপবংংভঁষ অর্থাৎ আমি অসহায়, অসমর্থ ও অকৃতকার্য। তাদের কাছ থেকে এমন বাক্য শোনা কারও কাম্য ছিল না।
এছাড়া নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও বসুরহাটে একই দলের দুগ্রুপের পাল্টাপাল্টি সভা সমাবেশকে কেন্দ্র করে একজন সাংবাদিক ও একজন শ্রমিক গুলিতে নিহত হয়েছে। তাতে নোয়াখালী জেলার ডিসির যে ভূমিকা থাকা উচিত ছিল তা দেশের মানুষ দেখতে পায়নি। এখানে ডিসির দায়িত্ব দায়সারা বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ ধরি মাছ না ছুঁই পানিরই নামান্তর। অনেকেই মনে করে ডিসির এহেন দায়িত্ব ঢেকে রাখার সুযোগ একেবারেই পরাহত। অথচ কর্মক্ষেত্রে যারা ন্যায়নীতি, নিষ্ঠা, আদর্শ ও মানুষের ভালোবাসা নিয়ে চাকরি করে তারা এসবকে কর্তব্য ও দায়িত্বের অংশ হিসেবেই মনে করে থাকে। মারহাবা, জিন্দাবাদ ও প্রশংসার দিকে ভ্রুক্ষেপ করতে দেখা যায় না। আর যারা জনগণের শোকে, দুঃখে ও দেশের জন্য কিছু করে থাকে, তাদের ন্যায়নীতি, সুনাম ও মানুষের ভালোবাসা ধামাচাপা পড়ে থাকেনি। এ নিবন্ধে বাস্তবতার আলোকে ও মানুষের অনাবিল ভালোবাসার নিরিখে কিছু আলোকপাত না করলেই নয়। এক সময় কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন এম.এ মান্নান (বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রী), জেলা প্রশাসক ছিলেন ফজলে কবীর (বর্তমানে গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক), জেলা জজ ছিলেন সহুল হোসাইন (অবসরপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার), জেলা জজ ছিলেন রুহুল আমিন (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি), পুলিশ সুপার ছিলেন গোলাম কিবরিয়া (অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি) উনাদের কথা আজও এলাকার শ্রেণী, পেশা ও সাধারণ মানুষ সশ্রদ্ধ ও সানন্দচিত্তে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। তাদের কাছ থেকে এলাকার জনগণ যে সেবা, ন্যায়নীতি, আদর্শ, সততা ও ভালোবাসা পেয়েছে তা আজও অম্লান ও ভুলে যাওয়ার নহে। তাদের মধ্যে ছিল না হিংসা, বিদ্বেষ ও স্বার্থপরতার চাপ। তাদের অফিস ও বাসভবন ছিল সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য খোলা। যে কোনো ব্যাপারে তাদের সাথে যে কারও কথা বলতে আদৌ সমস্যা হত না। বিশেষ করে দুইজন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কথা স্মরণযোগ্য।
চাকরিজনিত বদলী ও পদোন্নতির প্রেক্ষাপটে এক সময় জেলা প্রশাসক এম.এ মান্নান ও জেলা প্রশাসক ফজলে কবীর কিশোরগঞ্জ থেকে চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে এলাকার সাংবাদিক, রাজনীতিক, শ্রেণী পেশা ও সাধারণ মানুষ তাদের বাসভবন ও অফিসে এসে ভীড় জমায়। যেদিন উহারা বিদায় নেন, তখন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ, অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা বিদায় বেলায় এক নজর দেখার জন্য বাসভবনে এসে সমবেত হয়। সবার মাঝেই ছিল বিষাদের সুর। যেন জেলার অভিভাবক চলে যাচ্ছেন। তখন অনেকেই অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। সমবেত সকল শ্রেণীর মানুষ তাদেরকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বিদায় জানায়। যে অভূতপূর্ব দৃশ্যপট আজও অনেকের ক্যামেরা বন্দী হয়ে আছে। যা নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত কলেবরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করা সম্ভব হয়নি। কর্মজীবনে ন্যায়নিষ্ঠা, সততা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও দলমত নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসাই হয়তো এর প্রতিফলন ও অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শন। তাদের বিদায় বেলায় যতক্ষণ তাদের গাড়ী দৃষ্টিপাত হয়েছে, ততক্ষণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পের রতনের মতো অনেককেই বলতে শোনা গেছে, যদি উনারা আবার কিশোরগঞ্জের কর্মস্থলে চলে আসেন। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় অনেকেই কর্মস্থল ত্যাগ করার সময় কাহাকেও না জানিয়ে নিশিত রাতে চুপিসারে কর্মস্থল ত্যাগ করার নজিরও কম নহে।
মোদ্দাকথা মানুষকে ভালোবাসলে যেমন প্রতিদান পাওয়া যায়, আর ক্ষমতার আসনে বসে মানুষকে তুচ্চ, তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করলে প্রতিদান তো দূরের কথা বরং রাতের অন্ধকারে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয়। যদিও আজকাল এ দৃশ্যপটের সীমা পরিসীমা নেই। আমলাতান্ত্রিক রোষানল ও নিগ্রহের কারণে জনগণ ও সেবকদের মাঝে যে বৈষাদৃশ্য, পার্থক্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ ওহঃবৎষড়পশরহম (আমলাতান্ত্রিক জটিলতা) লক্ষ্য করা যায় তাদের মধ্যে এসব হাবভাব ও ক্ষমতার তোকাব্বরি স্পর্শ করতে পারেনি বলেই হয়তো মানুষ তাদেরকে এমনিভাবে ভালোবাসতে ও সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেনি।
স্বাধীনতার ৫০ বছর হলেও শাসন, প্রশাসনে আজও একটা শ্রেণী রয়েছে যারা বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের আমলাদের মতই রয়েছে। ওরা শাসন, প্রশাসনে এমন একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করে থাকে, তাতে মনে হয় ওরা জনগণের সেবক নহে বরং জনগণই তাদের সেবক। অনেক সময় অপ্রয়োজনেও অফিসের দরজা বন্ধ করে লালবাতি জ্বালিয়ে হরহামেশা গল্প গুজব করে যথেষ্ট সময় নষ্ট করে জনভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া মাসের পর মাস ফাইল আটকে রেখে চরম বেকায়দায় ফেলার প্রচেষ্টা চালায়। এ শ্রেণীটা যখন যে ক্ষমতায় আসে তারও পায়রুবি করে থাকে। ওদের নিজস্ব কোনো দর্শন না থাকলেও ক্ষমতাই এদের মুখ্যম।
যেভাবে দিনের পর দিন ক্ষমতার অপব্যবহার, বেসামাল দুর্নীতি, লালবাতি সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা কারও কাম্য নহে। তাই একজন বিদগ্ধ প্রথিতযশা প্রবাসী কলামিস্ট ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত কলামে লিখেছেন, “দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “শেখ হাসিনা সতর্ক হোন, সময় থাকতে আরও কঠোর হোন, এটাই আমার কামনা”। এ নিবন্ধে আমি সেদিকে যেতে চাচ্ছিনা। তবে আমার সামান্য অভিজ্ঞতার আলোকে বলব, কথার ফানুস না ছড়িয়ে কাজের মাধ্যমে আমাদিগকে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। যেদিকে রয়েছে শান্তি, স্বস্থি, প্রগতি, উন্নয়নের দর্পন ও মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তদোপরি আলজাজিরায় প্রচারিত তকমাকে অনেকেই গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করে থাকে। এ ষড়যন্ত্রকে নীচক মনে না করে, এ ব্যাপারে এখনই সচেতন ও সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।
ন্যায়নীতি, জনসেবা, দেশপ্রেম, আদর্শ ও মানুষের ভালোবাসার যে দিকদর্শন দেখিয়ে গেছেন এম.এ মান্নান, ফজলে কবীর, সহুল হোসাইন, রুহুল আমিন ও গোলাম কিবরিয়া সে পথ ধরে সামনে চলাই হোক পাথেয়। আর যে পথ অনৈক্য, ন্যায়নীতি আদর্শের পরিপন্থি ও মানুষকে ভালোবাসার নামে মেকিয়াভেলি সে পথ কারও কাম্য নহে। মানুষের ভালোবাসার পথকে রুদ্ধ করলে যেমনি রাতের অন্ধকারে কর্মস্থল থেকে অতি সংগোপনে বিদায় হতে হয়, তেমনি মানুষকে ভালোবাসলে বিদায় বেলায় শ্রেণী পেশা ও সাধারণ মানুষের অশ্রু নিংড়ানো ভালোবাসা, ফুলেল শুভেচ্ছা ও যেতে নাহি দিব তবু যেতে হয় কবির এ পংক্তি নিয়ে বিদায় হতে হয়। মানুষের ভালোবাসাতেই ভুবন করে জয়। এর বিকল্প কিছ্ইু নেই। মানুষের ভালোবাসার মাঝেই রয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের রহমত, কুদরত ও দয়ার দিকদর্শন।
কারও ক্ষমতা চিরদিন থাকে না। সব কিছুর উর্ধ্বে থেকে দেশপ্রেম, জনসেবা, ন্যায়নীতি, জাতীয়তাবোধ ও মানুষের ভালোবাসা। ক্ষমতায় থেকে যারা মানুষকে ভালোবেসেছে, সম্মান করেছে তাহারা মরিয়াও অমর। আজও তাদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে তাদের সমাধিতে মানুষের ঢল নামে। ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে যায়। আর যারা মানুষকে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করেছে তাদের কবরের পাশে যেমন কেহ যায় না তেমনি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। পরিশেষে উপসংহারে বলব, কোথায় নরক, কোথায় স্বর্গ কে বলে তা বুহদূর, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে, নাহি কিছু মহিয়ান।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট