দেশে প্রথমবারের মতো বুলেট ট্রেন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এক ঘন্টারও কম সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছা যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জিটুজি ও পিপিপির মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিআরসিসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) যৌথভাবে একটি কোম্পানি গঠন করে রেলপথটি নির্মাণ করবে। সেজন্য প্রস্তাবিত কোম্পানি প্রয়োজনীয় ঋণের সংস্থান ও রেলপথটি নির্মাণের দায়িতও¡ নেবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঋণ পরিশোধ করবে। ৫ বছর রেলপথটি পরিচালনার পর তা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হবে। বুলেট ট্রেন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক লাখ হাজার কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বুলেট ট্রেন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হবে। থাকবে ৬টি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন। পথের পুরোটাই হবে সংক্রিয় সিগনাল ব্যবস্থা সম্পন্ন। আর ট্রেনের গতি হবে ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার মিটার। যদিও ইতিপূর্বে কোরিয়ান দুই কোম্পানী হাইস্পিড রেল নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে ওই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। কারণ গত বছর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কিনে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। যে কারণে রেলওয়ে মেগা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চীনের উপরই ভরসা রাখতে চাচ্ছে।
সূত্র জানায়, চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি ও সিসিইসিসি বুলেট ট্রেনের জন্য হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের পিপিপি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রস্তাবটি রেলওয়েকে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসও রেলওয়েকে একই প্রস্তাবের বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে। প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রেলওয়ে মতামত নেয়ার জন্য তা সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সিআরসিসি ও সিসিইসিসির প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রচলিত আইন-কানুন মেনে তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন কোম্পানিটি গঠন করা হবে। ওই কোম্পানিই রেলপথটি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করবে। সুদসহ রেলপথটির নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ট্রেন পরিচালনার ব্যয় এবং কোম্পানির লাভসহ যে অর্থ খরচ হবে, তা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হবে। সিআরসিসি ও সিসিইসিসি স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণেরও ব্যবস্থা করে দেবে। তবে ওই ঋণ বাংলাদেশ রেলওয়েকে শোধ করতে হবে। ঋণ শোধ করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে সময় পাবে ২০ বছর। প্রতি বছর দুটি করে মোট ৪০টি কিস্তিতে ঋণ শোধ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণের জামিনদার হবে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী রেলপথটি নির্মাণের জন্য গঠিত কোম্পানির সঙ্গে সিআরসিসি ও সিসিইসিসির একটি চুক্তি হবে। ওই চুক্তির মাধ্যমে কেবল তারাই রেলপথটির নির্মাণকাজে অংশ নিতে পারবে। রেলপথটি নির্মাণের পর পরবর্তী ৫ বছর কিংবা আলোচনা সাপেক্ষে যে কোনো মেয়াদে গঠিত কোম্পানি তা পরিচালনা করবে। তবে এ সময়ে রেলপথটি থেকে যে অর্থ আয় হবে তা রেলওয়ের কোষাগারে জমা হবে।
এদিকে সিআরইসি ও সিসিইসিসি জয়েন্টভেঞ্চার গঠনের মাধ্যমে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা/লাকসাম হাইস্পিড রেলওয়ে’ প্রকল্পে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করে গত বছরের অক্টোবর রেলওয়ে প্রথম চিঠি দেয়। পরবর্তীতে চীনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দুটি সংস্থারই (সিআরসিসি ও সিসিইসিসি) চীন ও চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশে হাইস্পিড রেলপথের উন্নয়ন ও নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি ইতিমধ্যে অনেক দেশে জিটুজি-পিপিপি মডেলে একই জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড ট্রেন নির্মাণের জন্য ‘ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা/লাকসাম হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমেই করা হয়েছে রেলপথটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, যাতে খরচ হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। সমীক্ষায় হাইস্পিড রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার (শুধু ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম অংশ)। বর্তমান বিনিময় হারে (প্রতি ডলারে ৮৪ টাকা ৮৭ পয়সা) তার পরিমাণ ৯৬ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। সমীক্ষা অনুযায়ী, হাইস্পিড রেলপথটি ঢাকাণ্ডনারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম রুটে নির্মাণ করা হবে। রুটটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২২৭ কিলোমিটার। শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহনের জন্য রেলপথটি হবে। ডিজাইন স্পিড ধরা হয়েছে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। স্ট্যান্ডার্ড গেজের দুটি লাইন নির্মাণ করা হবে, যেগুলোর এক্সেল লোড হবে ১৭ টন ধারণক্ষমতার। বিদ্যুৎচালিত রেলপথটি হবে পাথরবিহীন। ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক ‘অটোমেটিক ব্লক’ সিগন্যাল ব্যবস্থা। রেলপথটিতে একটি ট্রেন বিরতিহীনভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে সময় নেবে ৫৫ মিনিট। আর বিরতি দিয়ে চললে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগবে ৭৩ মিনিট।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের পরিচালক কামরুল আহসান জানান, রেলপথ মন্ত্রণালয় এ বছরই চীনের সঙ্গে কাজ শুরু করতে চায়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরই শুরু হবে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের চূড়ান্ত কার্যক্রম। প্রকল্প বাস্তবায়নে চায়নার দুটি কোম্পানি আর রেলওয়ের সহযোগিতা থাকবে। প্রতিদিন ওই পথে ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ওই রেলপথ বর্ধিত করা হবে।