আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করেই রাজধানীর অধিকাংশ বাস চালকই সড়কে বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। ফলে অহরহ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও ওই প্রেক্ষিতে সরকারের নানা উদ্যোগের পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং আগের মতোই রাজধানীতে পুরোনো কায়দায় যাত্রীদের জীবন বিপন্ন করে প্রতিনিয়ত বাস-মিনিবাসের প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতা চলছে। প্রশাসনের সামনেই সড়কের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চালকরা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর ওই প্রতিযোগিতার কারণেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে যাত্রী, পথচারী এবং সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক, শ্যামপুর, তেজগাঁও, হানিফ ফ্লাইওভারে গণপরিবহনের অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে মোটরসাইকেল চালক, রিকশা চালক, কমিউনিটি পুলিশের সদস্যসহ ৮ জন নিহত হয়েছে। আর এ সময় আহত হয়েছে ২০ জন। পাশাপাশি করোনাকালে কোনো গণপরিবহনেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। পরিবহণ খাত এবং ভুক্তভোগী যাত্রীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাস স্টপেজগুলোতে বাস চালকদের প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়ে গেছে। পেছন থেকে সামনে যাওয়া, কখনো পেছনের বাসকে সামনে যেতে বাধা দেয়ার মতো ঘটনা স্বাভাবিক খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রকদের সামনেই এসব ঘটনার বেশির ভাগই ঘটছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ইতোমধ্যে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীর ১২১টি বাস স্টপেজের স্থান নির্ধারণ করেছিল। এসব স্টপেজ ছাড়া অন্য কোথাও বাস না থামানোর নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু ওই নির্দেশ অমান্য করে যত্রতত্র পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রী ওঠাচ্ছে এবং নামাচ্ছে। মূলত অধিকাংশ বাস চালকই আইন-কানুন মানছে না। অধিক যাত্রী ও মুনাফার লোভে কে কার আগে যাবে এ নিয়ে চালকদের দৌরাত্ম্য বছরের পর বছর চলে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে পদ্ধতিগত পরিবর্তন জরুরি।
সূত্র জানায়, রাজধানীর বাস চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কারণেই রাজপথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দিন দিন বড় হচ্ছে। রেষারেষি করে বাস চালাতে নিষেধ করা হলেও চালকরা শুনছে না। নগরীর বাড্ডা, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ক্লাসিক ভিক্টর, রাইদা, আকাশ, তুরাগ, রইস, রাজধানী, স্মার্ট উইনার, অছিম ও প্রচেষ্টা পরিবহন ফাঁকা সড়কে যাত্রী তুলতে রেষারেষি করে বাস চালাচ্ছে। সামনের বাস না সরলে পেছনের বাসটা সজোরে ধাক্কা মারছে। শুধু ওই বাসগুলো নয়, গুলিস্তান-বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ সড়কেও একই অবস্থা। কোনো শৃঙ্খলা না মেনেই শিকড়, বোরাক, আনন্দ কোম্পানির বাসগুলো চলাচল করে। মতিঝিলে এটিসিএল, এফটিসিএল, বাহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির বড় বাসগুলো একটার পেছনে আরেকটা লেগে থাকে। যাত্রাবাড়ী থেকে আসা ৮ নম্বর রুটের বাসসহ অন্যান্য রুটের মিনিবাসও একটা আরেকটার সামনে পথরোধ করে আগে যাওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি ট্রাফিক পুলিশের সামনেই প্রতিটি স্ট্যান্ডে বাস চালকরা বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি রাখে, যাত্রী তোলেন। সিটগুলো যাত্রীতে পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ স্ট্যান্ড ছাড়তে চায় না। যাত্রীদের চাপাচাপিতে বাসটি যখন অপর স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যায় তখন তার গতিও থাকে বেপরোয়া। সেক্ষেত্রেও কে কার আগে যাবে, তা নিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তখন সড়ক পারাপার হতে থাকা পথচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে।
সূত্র আরো জানায়, চুক্তিভিত্তিক বাস চলাচলের কারণেই চালকরা পরস্পরের মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। প্রতিযোগিতা না করতে গুপরিবহণ সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। লকডাউনের পরবর্তী সময় এ প্রতিযোগতা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি তা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে পরিবহন চালকরা জানান, চালক-হেলপার ও কন্ডাক্টর ৩ জন মিলে বাস মালিকের কাছ থেকে লিজ নেয়। সেজন্য প্রতিদিন মালিককে ১ হাজার ১০০ টাকা আর চাঁদা বাবদ ৯০০ টাকাসহ সব মিলিয়ে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা খরচ হয়। তারপর যা থাকে ওই তিন জনে ভাগ করে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই চালকরা বাস চালিয়ে খরচ বাদ দিয়ে নিজেদের আয় বাড়াতে প্রতিযোগিতা করে। অথচ মালিকের এক টাকাও লোকসান নেই। সন্ধ্যার পর তারা গুনে-গুনে টাকা বুঝে নেয়। এমন অবস্থায় যাত্রী তুলতে প্রতিযোগিতা না করলে পরিবহন শ্রমিকরা কি খাবে?
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্যাহ জানান, সমিতির প্রতিটি মিটিংয়ে মালিক ও শ্রমিকদের সতর্ক করা হয়। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে স্বাস্থ্যবিধি মানারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু চালকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই নির্দেশ তোয়াক্কা করে না। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে ৫টি কোম্পানির অধীনে সিটি সার্ভিসের বাস পরিচালনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকেও এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকবে না।