আজ অগ্নিঝরা মার্চ মাসের পঁচিশতম দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের দিনটির কথা স্বরণ করতে গিয়ে অনেকেই ওই দিনকে অনেকভাবে সঙ্গায়িত করেছেন। কারণ ২৫শে মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালি নিধনযজ্ঞের ইতিহাসের সর্বকালের ঘৃর্ণিত বর্বতা এই নিরীহ বাঙালিদের মনে তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহার জন্ম দেয়।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রির নাম ২৫ মার্চ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিতদিন। একাত্তরের অগ্নিঝরা ২৫ মার্চে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা। গণহত্যার নীলনকশা 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পাকিস্তানি দানবরা মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যা। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় অর্ধলক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিক হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর। সে রাতে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক, কামান আর মেশিনগানের গোলায় হত্যা করে শত শত দেশপ্রেমিক তরুণ, যুবক, আবালবৃদ্ধবনিতাকে। মুক্তিকামী বাঙালির রক্তে সে রাতে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ, বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রান্তর। দখলদার সেনাদের পৈশাচিক উল্লাস, লুণ্ঠন, হত্যা ও নির্মম অগ্নিসংযোগে ধ্বংস হয়েছিল বাড়িঘর, সম্পদ ও জনপদ।
একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিন্তান সরকারের কোনো আইন তখন এদেশে কার্যকর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এদেশের প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করা হয়। স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালিদের ভয়াল কালো রাত ২৫শে মার্চ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মানব ইতিহাসের যে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেই পৈশাচিকতার ওপর ভর করেই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলার অকুতোভয় দামাল সন্তানেরা।
একারণে কেউ বলছে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল ২৫শে মার্চের কালো রাত। আবার অন্যদিকে ওইদিন হানাদার বাহিনীকর্তৃকনৃশংস গণহত্যা করায় কেউ বলছে- মানবাধিকারের সব শ্রিষ্টাচার লঙ্ঘন করার দিন। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের ওই বর্বরোচিত হামলায় সমগ্র বাঙালি জাতির পাশা-পাশির পুরো বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছিলো উন্মক্ত পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাকা-।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার পাশাপাশি বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখপত্র সংবাদপত্র অফিসগুলোতেও হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে সক্রিয় সাংবাদিকদের বৃহত্তম অংশ আত্মগোপনে চলে যান বা ঢাকা ত্যাগ করেন। তাদের একটি অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেন। ঢাকায় থেকেও কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং বিশ্ববাসীকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানাতে থাকেন। ঢাকায় অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
একাত্তরের সেদিন সকাল ১১ঘটিকার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১টি হেলিকাপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল নজর, মেজর নাজির হোসেন শাহ, মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল খোদাদাদ খান ও মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান অন্যান্য স্টাফসহকারে রংপুর ২৩ ব্রিগেড সেনানিবাসে যান। সেনানিবাসের প্রধান ব্রিগেডিয়ার আব্দুল আলী মালিক তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে সোজা তার বাসভবনে নিয়ে যান। সেখানে একমাত্র ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) বাঙালি ক্যাপ্টেন ওয়াজিশকে ছাড়া সব ইউনিট কমান্ডদের নিয়ে ব্রিগেডিয়ার মালিক বৈঠক করেন। বৈঠকের কয়েক মিনিট পর হেলিকাপ্টার রংপুর ত্যাগ করে। হেলিকাপ্টারটি রাজশাহী, যশোহর, চট্টগ্রাম, ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে বিকালে ঢাকা ফিরে আসে। এ খবর গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়লো যে, পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান ইয়াহিয়ার অন্যতম প্রধান আলোচনাকারী এম.আহমদ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছে। এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু পার্টি গুলোর নেতা ওয়ালি খান বলেন- ‘বেজেঞ্ছে এবং নিয়া মমতাজ দত্তলতানা ঢাকা ত্যাগ করেছেন।’ বিকালে ইয়াহিয়া খানের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা এ.কে. ব্রোহীও করাচিতে ফিরে যান।
উল্লেখ্য, আগের দিন ২৪শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-ইয়াহিয়া খানের দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নতুন ফর্মূলার পেক্ষাপটে ক্ষমতা হস্তান্ত সংক্রান্ত প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা এবং প্রস্তাবিত বৈঠকে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবের পরামর্শদাতারা এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। তাদের ধারনা মুজিবের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হইত ব্যর্থ হয়নি। বিকালে পাকিস্তানি সেনা জেনারেল ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন- প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক হবে কেননা, মুজিব ও প্রেসিডেন্টের পরামর্শদাতাদের বৈঠক নতুন আবদার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কুচক্রীরা সবকিছু ম্লান করে দিয়ে ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ইতিহাসের অন্যতম পৈশাচিক হত্যাকা- ঘটায়।
বির্তকৃতভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় পাকিস্তানি বাহিনী ওই রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা মহানগরীতে হত্যাযজ্ঞ চালায়। অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিকামী বাঙালির কন্ঠে তখন জেগে ওঠে অন্তিম আর্তনাদ। হানাদারদের ট্রেসার বুলেটে ঘুমন্ত মানুষগুলোর ভাঙে ঘুম। অন্ধকার ঢাকার আকাশ আলোয় আলোকিত করে বারবার।
চারিদিকে দেখা গিয়েছিলো বিজলীর মত আগুনের লেলিহান শিখা। রাত ১২ ঘটিকা পেরিয়ে হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গর্জে উঠেছিলো মেশিনগান। একটা নয়, দ’টা নয়, অসংখ্য আগুনের লেলিহান শিখা। মুহূর্তে মধ্যে আগুনে লালে লাল হয়ে যায় গোড়া আকাশ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর মর্মভেদী আর্তচিৎকারে শোকের মাতম নেমে আসে ধরাতলে। ভারী হয় ঢাকার আকাশ-বাতাস। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। রাায় রাস্তায় জমে উঠে লাশের স্তুপ। কিন্তু এর মধ্যেও গড়ে উঠে প্রতিরোধ হানাদারদের প্রতিরোধ করা হয় রাজারবাগে, পিলখানায়। পিলখানা ই.পি.আর হেডকোয়ার্টাও আক্রমণ করে ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যাদের অবস্তান ছিলো পিলখানাতেই। পাকিস্তানি বাহিনীরা পিলখানার সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমন চালায়। প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনের দখিকিন দিকথেকে আক্রমণ চালায়। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও তেজগাঁও থানা পুলিশের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর খবরাখবর অবগত হয়ে রাজারবাগের ৪শত পুলিশ পজিশন নিয়ে তৈরি হয়েই ছিলো। আক্রমণের সাথে সাথে পুলিশ বাহিনীর হাতের সবগুলো রাইফেল এক সঙ্গে গর্জে উঠেছিলো। অবস্থার বেগতিক দেকে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু সরে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রের সাহায্যে বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। পুলিশ বাহিনীও তাদের ৩০৩ রাইফেল দ্বারাই অজেয় মনোবল নিযে টিকে থাকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পুলিশের এ.এস.আই. আসমত আলী, সুবেদার আবুল হাসেম, নায়েক মোহাম্মদ আলী, সার্জেন্ট মূর্ত্তজা প্রমুখ অশেষ বীরত্ব ও কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। উন্নতমানের অস্ত্র থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ২৬শে মার্চ ভোর বেলার মধ্যেই সমগ্র রাজারবাগ তাদের দখলে নিয়ে সক্ষম হয়।
গভর্নর হাউসে ওই রাতে ই.পি.আর সৈন্য ছিলো ১১০জন। রাত ১২টার সময় পাকিসতান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ডি.আই.টি. ভবনের ওপর থেকে গভর্নর হাউসে অবস্থানরত ই.পি.আর. বাহিনীর ওপর মেশিনগানের গুলি বর্ষণ শুরু করে। ই.পি.আর. বাহিনীর জোয়ানরা সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। এভাবে তারা সারা রাত কাটিয়ে দেয়।
২৫শে মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট হাউসে ই.পি.আর বাহিনীর ২কোম্পানি সৈন্য প্রহরায়রত ছিলো। সেদিন সন্ধ্যার সময় ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী প্রেসিডেন্ট হাউসে এসে জমা হতে থাকে। ই.পি.আর বাহিনীর সেক্টর অধিনায়ক (অবাঙারি) সন্ধ্যার পর প্রেসিডেন্ট হাউসে এসে বাহিনীর সব সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন, তাই হাতিয়ার জমা করে প্রত্যেকের বিশ্রাম করা উচিত। কিন্তু রাত ১১টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব বাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। তবে পরবর্তী কাহিনী বড়ই করুণ ও মর্মান্তিক।
২৫শে মার্চ গভীর রাতে লে. কর্ণেল তারেক রসুল দিনাজপুরে উপস্থিত অফিসার ও সিনিয়র জে.সি.ও. এর সদস্যদের নিয়ে এক বৈঠক করেন। বৈঠকে সামরিক আইন জারীর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়।
অপরদিকে রাত ১২টার পর রংপুরের পাকিস্তানি বাহিনী রংপুরস্থ ই.পি.আর ও নিরস্ত্র জনতার ওপর বেপরোয়াভাবে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সারা রাত গোলাগুলি চলতে থাকে। এ রাতে সেনাবহিনীর বেশ কিছু হতাহত হয়। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর কয়েকটি দল রাজশাহী ও বগুড়া সেনানিবাস থেকে বের হয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাতভর রাজশাহী ও বগুড়ার পুরো জেলায় টহল দিয়ে শেষরাতে তারা সেনানিবাসে ফিরে যায়। এদিন পুলিশ, ছাত্র-জনতা মিলে শহরের বিভিন্ন রাস্থায় ব্যারিকেড দিতে থাকে। ই.পিআর সৈনিকরাও বেসামরিক পোশাকে তাদের সাহায্য করেছিলো। সন্ধ্যায় কয়েকটি পাকিস্তানি সেনা ভর্তি গাড়ি শহরের পুলিশ লাইনের পাশে গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। পুলিশ বাহিনীও প্রস্তুত ছিলো এবং তারাও পাল্টা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। অতর্কিতভাবে সারারাত গোলাগুলি চলে। অবস্থার বেগতিক দেখ পাকিস্তানি বাহিনীরা রাতেই আর অগ্রসর না হয়ে সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করে। তবে রাজশাহীও বগুড়ায় এ রাতে তেমন কোনো অঘটনের খবর পাওয়া যায়নি।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হামলা ও নৃশংসতার খবর অবগত হবার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৬নং উইং- এর ই.পি.আর সৈনিকরাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যে কোনো অবস্থার মোকাবেলার জন্য নিজেদেরকে পস্তুত রাখেন। ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন উইং অধিনায়ক মেজর নাজমুল হকের পরামর্শক্রমে কোয়ার্টার গার্ড ও অন্যান্য স্থানে অবাঙালিদের পরিবর্তে বাঙালিদের নিয়োগ করেন। কিন্তু নের্তৃত্বের অভাবে তারা কোনো সুষ্টু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেননি।
ওদিকে খুলনায় ৫নং উইং সদরে অবস্থিত ই.পি.আর এর ‘বি’ কোম্পানি ও সাপোর্ট প্লাটুুনের বাঙালি সৈনিকরা ওই রাতেই বন্দি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে বন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে অনেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। অবশ্য ৫নং উইং এর অন্যান্য কোম্পানিগুলি প্রথম থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো। সুবেদার আবদুল জলিল শিকদারের নের্তৃত্বে ‘এ’ কোম্পানি, নায়েব সুবেদার জব্বার আলীর নের্তৃত্বে ‘সি’ কোম্পানির সাথে সংযুক্ত একটি প্লাটুন, সাতক্ষীরার ঝুমঝুমপুরে অবস্থানরত ‘ডি’ কোম্পানি যার এক প্লাটুন ছিলো যশোহর জেলখানা প্রহরায় এবং একটি প্লাটুন ছিলো কোম্পানি সদর ঝুমঝুমপুরে, তোবারক উল্লাহর নের্তৃত্বে ‘ই’ কোম্পানি কালীগঞ্জ থেকে অগ্রসর হয়ে মেজর ওসমানের নির্দেশে ৩টি কোম্পানি যশোহরের ঝিকরগাছায় একত্রিত হয়। পরে বাঙালি ই.পি.আর বাহিনী নায়েব সুবেদার ইলিয়াস পাটোয়ারির নের্তৃত্বে এক কোম্পানি যশোহরের কারবালার কাছে, নায়েব সুবেদার সাইদুর রহমানের নের্তৃত্বে এক কোম্পানি যশোহরের উপশহরে গরীব শাহ্ মাজারের কাছে এক প্লাটুন ও যশোহর খুলনা সড়কে এক কোম্পানি সুবেদার হাসান উদ্দিন আহমেদদের নের্তৃত্বে প্রতিরক্ষা গ্রহণ করে। সার্বিক প্রতিরক্ষার নের্তৃত্বে থাকেন সুবেদার আবদুল জলির শিকদার।
অন্যদিকে যশোহর সেক্টর সদরের বাঙালি ই.পি.আর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে। হাবিলদার তোফাজ্জল আলীর নের্তৃত্বে ৩২জনের ক্যাডার দল সন্ন্যাসদীঘিতে এবং নায়েব সুবেদার আবদুল মালেকের নের্তৃত্বে ৬০জন সেক্টর সদর প্রতিরক্ষায় থাকেন চাচড়ার মোড়ে নায়েক মতিউর রহমানের নের্তৃত্বে একটি ৬ পাউন্ডার কামান ও হাবিলদার তৈয়বুর রহমানের নের্তৃত্বে অপর ১টি ৬-পাউন্ডার কামান চাচড়ার ট্রাফিক আইল্যান্ডে বসানো হয়।
আকস্মিক আক্রমণে পজিশন ঠিক করে উঠতে পারেনি বাঙারি সৈন্যরা তবুও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বাঙালি সৈন্যরা লড়েছিলো শত্রুর বিরুদ্ধে।
এদিন বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘আমার আশংকা হচ্ছে, আলোচনা ও রাজনৈতিক মীমাংসার নামে কালক্ষেপণ করে বাঙালিদের দমন করার গোপনে পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।’
২৫শে মার্চ সারা দিন ঢাকা শহরে চলে স্বাধীকার অর্জনের বাঙালি জনতাদের প্রতিবাদ মিছিল। বাঙালিদের উদ্দেশ্য ভেস্তে দেওয়ার লক্ষ্যে রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানির-হানাদাররা বাঙালিদের সৃষ্টি করে ব্যারিকেড। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলে মুক্তিপাগল মানুষের সঙ্গে স্বৈরাচার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর।
সর্বত্রজুড়ে বিরাজ করে এক অজানা আতঙ্ক এবং অশুভ পায়তারা। সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। অপরদিকে এ রাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। জনশ্রুতিতে প্রকাশ. রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা বেতারে একবার শুনা গিয়েছিলো। পরে পিলখানা, ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে বার্তা আকারে পাঠানো হয়। ওই বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য সমগ্র বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান করেন। তিনি তার বাসভবন থেকে ঘোষণা করেন- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র জনতা পুলিশ ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র পতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু আরো জানান, আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিককে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। আপনার শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।
এদিন ধানমন্ডির শহীদ মঈনুল রোডের ৩২নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পৃথক পৃথক মিছিল ভিড় জমায় ওই বাসবভনে। আর বঙ্গবন্ধু মিছিলের সামনে হাজির হয়ে স্বাধীকার আন্দোলন বেগবান করতে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। এবং সবাইকে স্বৈরাচার পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের জন্য মুক্তিকামী বাঙালিদের তৈরি হবার আহ্বান জানান। দুপুর ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু খবর পান পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সহচরসহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন।
অপরদিকে এদিন ৪শত থেকে ৫শত সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হন। তাদের মধ্যে প্রায় ২শত জন ছিলেন বিদেশী সাংবাদিক। ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে ‘ছক’ মোতাবেক পজিশন নেয় গোলান্দাজ সাঁজোয়া ও পদাতিক বাহিনীর ৩ ব্যাটালিয়ন ঘাতক। রাত গভীর হওয়ার আগেই ক্যান্টমেনট থেকে জিপ, ট্রাক বোজাই পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা শহরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে ট্যাংক ও সাঁজোয়া থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয়। ওইসসময় বিদেশী সাংবাদিকরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) অবস্তান করছিলো।
রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই হোটেল ঘিরে ফেলে। বাঙালিরা কেউ বাইরে বেরুলেই গুলির হুকুম দেয়া হয় পাকিস্তানের পক্ষ্যে। মেশিন গানের গুলিতে চারিদিকে চলে আতংক। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ১২তলায় সুদক্ষ দেহরক্ষীদের কড়া প্রহরায় এ রাতে নির্বিঘেœ ঘুমাচ্ছিলেন পাকিস্তানি পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। আর মধ্য রাতে মার্কিন ট্যাংকগুলো কামান উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সঙ্গে লরি বোঝাই সৈন্য। প্রথমে পাকিস্তানি পাষ- সৈন্যরা গুলি চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে। এতে মারা যায় নাম জানা অজানা শতাধিক ছাত্র। পাকিস্তানি সেনারা এরপর জগন্নাথ হলে ঢুকে সাবমেশিন দিয়ে গুলি করে হত্যা করে আরো কম্পক্ষে দেড় শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক। রোকিয়া হলেও আক্রমণ থেকে বাদ দেয়নি হায়েনার দল। গুলি চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য ছাত্রীকেও। এসময় কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়। এ রাতে ড.গোবিন্দ চন্দ্র, ড. জ্যোতির্ময় গুহা ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্রচার্য, অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯জন অধ্যাপককে খুন করে পাকিস্তানি সেনারা। এছাড়াও আশে পাশের ঘুমন্ত বাঙালি জনতাকে ব্রাসফায়ারে হত্যা করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং হোস্টেলেও গুলি করে বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। পূর্ব পাকিস্তানের রাইফেলসের সদর দফতরেও কামানের গোলা ও রকেট নিক্ষেপ করে পাকিস্তানিরা। ফলে বহু তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্ছিত হয় ঢাকা পিলখানার মাটি। এসময় পাকিস্তানিদের ঠেকাতে রাজপথে নামেন এদেশের কলম যোদ্ধা সাংবাদিকরা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের অদূরে সাকুরার পেছনে স্বাধীনতাকামী বীর জনতা ‘দি পিপল’ কাগজের অফিসের ৩ তলায় রাতের অন্ধকারে সাংবাদিকরা মিছিল বের করে সেøাগান দেয়, ‘বীর বাঙলি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ মুক্ত কর, বাঙালিরা এক হও’।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে স্বৈরাচার পাকিস্তানিরা সাংবাদিকদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কাছেই অবস্থান করছিলো গোলন্দাজ ব্যাটালিয়ানের জওয়ানরা। তারা সঙ্গে সঙ্গে কামানের গোলা দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় মুক্তিকামী মিছিলকারী সাংবাদিকদের। পরে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ওই কাগজের অফিসে। অপরদিকে ইপিআর ঘাঁটিতেও আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ক্যাপ্টেন রফিক অন্যকর্মস্থল থেকে ফিরে এসে রাত ১১টার মধ্যেই সেখানে অবস্থানরত ইপিআরের ৩শত পশ্চিমা সৈন্যদেরকে বন্দি করতে সক্ষম হন। এবং তিনি অস্ত্রাগার থেকে দখলে নেন বিপুল পরিমানে অস্ত্রশস্ত্রসহ গোলবারুদ। এ রাতে চট্টামের পতেঙ্গা বিমান বন্দরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হন ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা। ক্যাপ্টেন রফিক চট্টগ্রামের হালিশহর ইপিআর ঘাঁটি থেকে ১শত সৈন্যকে একাধিক গ্রুপে ভাগ করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পাঠান। ক্যাপ্টেন রফিক ২টি প্লাটুনকে পাঠান উপকূলীয় বাঁধে। ১টি প্লাটুনকে পাঠান রেলওয়ে হিলে। সেখানেই ক্যাপ্টেন রফিক স্থাপন করেছিলেন পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার হেড কোর্য়াটার। বাকী সৈন্যদের পাঠান হালিশহরে।
অন্যদিকে রাত ১২টায় ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে পশ্চিমা বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ১হাজার বাঙালি সৈন্যরা শাহাদাত বরণ ও বাকী ১হাজার সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই বন্দি হলে সেখানে প্রতিরোধ যুদ্ধের আর কোনো সম্ভবনাই থাকেনা। অনেক বাঙালি অফিসার-সৈনিক পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে মেজর আশরাফ, মেজর রেজাউর রহমান, ক্যাপ্টেন বাশার, ক্যাপ্টেন মহসীন, ক্যাপ্টেন এনাম ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া পালিয়ে এসে বাইরে মুক্তিযুদ্ধাদের সঙ্গে দেশমার্তৃকার মুক্তি যুদ্ধে শামিল হন।
২৫ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হওয়ার দিন। একাত্তরের সেদিনে বাঙালির বুকে এক নির্মম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেয় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী। যে ক্ষতচিহ্ন জুড়ে এখনো জ্বালাময়ী দগদগে ঘা বেদনা বাড়ায়। যে যন্ত্রণা এখনো পুষে রাখে কোটি কোটি বাঙালি প্রাণ। স্মৃতি জুড়ে বারবার ফিরে আসে সেই জলপাই রঙের ট্যাংক। ফিরে আসে অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে যন্ত্রণা হয়ে। ফিরে আসে প্রকান্ড শহরের প্রশস্ত রাস্তায়। এ রাতে স্বাধীনকামী বাঙালি জনতার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি স্বৈরাচার হানাদার মানুষ নামের পশুরা। এক নিমিষেই বাঙালির সবকিছু ল-ভ- করে দেয় ওরা। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনারা মেশিনগান, মর্টার-ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে অন্তত ৫০ হাজার ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষকে। হানাদার বাহিনী ট্যাংক, বাজুকা, মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে নেয়। প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর পিলখানা ইপিআর ব্যারাকের পতন হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন হামলাকারীদের কব্জায় আসে রাত ২টার সময়। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকায় যখন এ অবস্থা তখন পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী বেলুচ রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের রাত ১২টায় দুই হাজার বাঙালি অফিসার ও সৈনিকের উপর ট্যাংক-মর্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হত্যা করে এক হাজার বাঙারি অফিসার ও সৈনিককে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ‘এমভি সোয়াত’ জাহাজে অস্ত্র আনতে গিয়ে মুক্তি সংগ্রামী তিন বাঙালি সিভিলিয়ান ও রাজনীতিকের এক গোপন বার্তায় এবং সহকর্মী বাঙালি সেনা অফিসারের ত্বড়িত সংবাদে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে আসেন মেজর জিয়াউর রহমান। পাকিস্তানি অফিসার লে.কর্ণেল জানজুয়ার নির্দেশে মেজর জিয়াউর রহমান বন্দরে যাচ্ছিলেন সোয়াতে অস্ত্র ডেলিভারি আনতে। পাকিস্তানি লে.কর্ণেল জানজুয়ার ষড়যন্ত্র কোনো ভাবেই বুঝতে না পারায় মেজর জিয়াউর রহমান যাচ্ছিলেন সোয়াতে অস্ত্র ডেলিভারি আনতে। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান জীবন বাজি রেখে দ্রুত গাড়ি নিয়ে রওনা হন মেজর জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্যে। বন্দরের একেবারে কাছে ১টি ব্যারিকেডের সামনে এসে তিনি মেজর জিয়াউর রহমানকে অবহিত করেন- সোয়াতে অস্ত্র কালাস করতে গেলে তার জীবনহানি হতে পারে। এটা লে.কর্ণেল জানজুয়ার ষড়যন্ত্রই মাত্র। অতঃপর জিয়া ঘটনাটি বুঝতে পেরে ফিরে যান ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। রাতেই জিয়া ষড়যন্ত্রকারী লে. কর্ণেল জানজুয়াসহ পশ্চিমা সৈন্যদের গ্রেফতার করে কামান্ড হাতে নেন। অবস্থার বেগতিক দেখে বাকী পাকিস্তানিরা রওনা হয় কালুরঘাট হয়ে পটিয়ার দিকে।
বড়ই বিভিষিকাময় একাত্তরের ২৫শে মার্চের ভয়াল কালো রাত। এ রাতে এদেশে বিশ্ব সভ্যতার অন্যতম কলংকজনক নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ২৫শে মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালি নিধনে মত্ত হয়ে ওঠেছিলো পাকিস্তানি নিষ্ঠুরতম বর্বর সেনারা। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসিম মামুন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ ৬দিনকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপূর্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়- ২৫শে মার্চ রাত ১১ঘটিকায় ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। এ রাতে হনাদার বাহিনীর আঘাতের পরপরই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্বতস্ফুর্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিলো। সেদিন প্রথম বিদ্রোহের সূচনা হয় চট্টগ্রামে রাত সাড়ে৮টার দিকে। এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন- ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস পুলিশ, আনসার ও যুব সম্প্রদায়।
এরপর রাত ১টা ১০মিনিটের সময় ১টি ট্যাংক ১টি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শহীদ মঈনুল রোডে ধানন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে এবং তাকেসহ ৪জন চাকর ও ১জন দেহরক্ষীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা গ্রেফতার করে। এসময় পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানার পাশে লুকিয়ে থাকা ১জন সৈন্য প্রহরীকে খুন করে। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর শুনে রাত ৩ঘটিকার সময় চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানিদের ওপর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০০৯ সালের ২৬শে মার্চের বিশেষ সংখ্যা দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হায়দার আকবর খান রনোর বিশেষ নিবন্ধন ‘পেছনে ফিরে দেখা : ১৯৭১ সাল’ এ তিনি উল্লেখ্য করেন, ১৯৭১সালের ২৫শে মার্চে পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। প্রায় দুই লাখ মানুষের সমাগম ঘটে জনসভায়। এতে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন, কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ কান মেনন (ওয়ার্কাস পার্টির প্রধান), হায়দার আনোয়ার খান জুনো, আতিকুল রহমান সালু ও হায়দার আকবর খান রনো নিজে। তিনি আরো উল্লেখ্য করেন, এটাই ছিলো পাকিস্তান আমলের শেষ জনসভা। অর্থাৎ পাকিস্তান শাসন আমলের বাঙালিদের সর্বশেষ জনসভা। বিশ্রিষ্ট কলাম লেখক এমাজ উদ্দীন আহমদ তার ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের তাৎপর্য নিবন্ধন এ উল্লেখ্য করেন, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের কাছে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী ২৫শে মার্চের রাত্রিতে সংঘটিত বিভীষিকা সম্পর্কে তার বইতে লিখেছেন: ‘শান্তিপুর্ণ রাত্রি পরিণত হলো আর্ত-চিৎকার, করুণ ক্রন্দন এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের নির্মম কালে’......এই সামরিক অভিযান নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার নিরিখে চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের বোখারা ও বাগদাদের হত্যাকা- অথবা ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার কর্তৃক জালিয়ানওয়ালাবাগের নরহত্যার চেয়েও ছিলো বেশি ভয়ঙ্কর। আরো বেশি বিভীষিকাময়। [‘চবধপবভঁষ হরমযঃ ধিং ঃঁৎহবফ রহঃড় ধ ঃরসব ড়ভ ধিরষরহম, পৎুরহম ধহফ নঁৎহরহম. ৃঞযব সরষরঃধৎু ধপঃরড়হ ধিং ধ ফরংঢ়ষধু ড়ভ ংঃধৎশ পৎঁবষঃু,সড়ৎব সবৎপরষবংং ঃযধহ ঃযব সধংংধপৎবং ড়ভ ইঁশযধৎধ ধহফ ইধমযফধফ নু ঈযবহমরু কযধহ ধহফ ঐধষধশঁ কযধহ ড়ৎ ধঃ ঔধষরধহধিষধনধময নু ঃযব ইৎরঃরংয এবহবৎধষ উুবৎ.’]
একাত্তরের এদিনে মধ্য রাতে পাকিস্তানি সাময়িক বাহিনী দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক পিপল পত্রিকার কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে অন্যান্য পত্রিকাগুলো প্রকাশ হলেও শাষক গোষ্ঠীর চাপ উপক্ষেকা করে সংবাদ কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখেন।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত স¤পর্কে লিখেছেন, 'সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে। ঢাকায় ঘটনা শুরু মাত্র হয়েছিল সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।'
পরিশেষে বলা যায় যে, পূর্ব বাংলায় একাত্তরের ২৫শে মার্চের গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদা বাহিনীরা ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর বর্বরচিত হামলা হত্যাকান্ড চালিয়েছে তা কোনো দিনই বাঙালি জাতি ভুলবে না।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)