স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় ও ব্যাপক তা-ব চালায় ইসলামি সমমনা দলগুলো। গত শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে থানা ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হেফাজত কর্মীদের হামলার পর সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তা-ব চালিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করেছে কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা। আর রাজধানীতে মোদীবিরোধীরা সংঘাতে জড়ায় পুলিশ ও স্থানীয়দের আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে, তাতে আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। এরপর সন্ধ্যায় ঢাকার পল্টনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অফিসে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে শনিবার সারা দেশে বিক্ষোভ এবং রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেওয়া হয় হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে। সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সহকারী প্রচার সম্পাদক মাওলানা এহছানুল হক বলেন, আজকে সারাদেশে যে হামলা, মোদীবিরোধী আন্দোলনে যে হামলা হয়েছে আমাদের ওপরে, চট্টগ্রামে চারজন শাহাদাত বরণ করেছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা হয়েছে- এর প্রতিবাদে আগামীকাল (শনিবার) দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে- হেফাজতে ইসলাম কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী। সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকও বক্তব্য দেন। ২০১০ সালে দেশের কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ হয়। নারী নীতির বিরোধিতা করে আলোচনায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে ব্যাপক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে সংগঠনটি। ওই বছর ৫ মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান করে দিনভর তা-ব চালায় হেফাজতকর্মীরা। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতায় অবস্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসে সংগঠনটি। এরপর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনের বিরোধীতা করে তা-ব চালায় তারা।
বায়তুল মোকাররম: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে জুমার নামাজের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসা একদল লোক ভারত ও নরেন্দ্র মোদী বিরোধী নানা স্লোগান দিতে শুরু করলে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও আওয়মী লীগ কর্মীদের সঙ্গে তাদের মারামারি বেঁধে যায়। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও জল কামান ব্যবহার করে। এ সময় মসজিদের উত্তর গেইটের সামনে রাস্তার পাশে দুটি মোটর সাইকেলে আগুন দেয় মোদীবিরোধীরা। পুলিশের দিকে বৃষ্টির মত ঢিল ছোড়ে তারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, বায়তুল মোকাররমে এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬০ জন আহত অবস্থায় হাসপাতালে এসেছেন, তবে কেউ ভর্তি হয়নি। সাহাদত নামের গুরুতর আহত এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেছেন তার স্বজনরা। অন্তত ১৫ জন গণমাধ্যমকর্মী এদিন সেখানে দায়িত্ব পালন করার সময় আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং নামাজ পড়তে যাওয়া সাধারণ মানুষও রয়েছেন বলে পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান। বায়তুল মোকাররমে আসলে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার নূরুল ইসলাম বলেন, জুমার নামজের পর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে কিছু মুসল্লি জড়ো হয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল, জুতা দিচ্ছিল। তারা উত্তেজনাকর বক্তব্য দিলে সাধারণ মুসল্লিরা বাধা দেয়। এতে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভরত মুসল্লিরা মসজিদে ঢুকে সেকাখ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং মসজিদের টইলস ভেঙে ফেলে বিভিন্ন ক্ষতিসাধন করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার শেল ছোড়ে। কারা এ কাণ্ড ঘটিয়েছে জানতে চাইলে বিভাগের উপকমিশনার নূরুল ইসলাম বলেন, যারা বিক্ষোভ করছিল তারা মূলত ইসলামি কয়েকটি সমমনা দল। তবে এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বায়তুল মোকাররমের কর্মসূচি হেফাজতের ছিল কি না জানতে চাইলে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, সেখানে সাধারণ মুসল্লিরাই প্রতিবাদ করছিলেন। আমাদের লোকজনও থাকতে পারেৃ।
হাটহাজারি: হেফাজতে ইসলাম পরিচালিত হয় মূলত চট্টগ্রামেে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম থেকে। গত শুক্রবার সেখান থেকেই বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় বেলা সোয়া ২টার দিকে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা থেকে কয়েক হাজার হেফাজতকর্মী মিছিল নিয়ে বের হয়। লাঠিসোঁটা নিয়ে তারা হাটহাজারী থানা, ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও ডাক বাংলোতে হামলা চালায়। চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মছিউদ্দৌল্লাহ রেজা বলেন, মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে বিনা উসকানিতে হেফাজত কর্মীরা থানায় হামলা চালায়। তারা থানা কম্পাউন্ডে ব্যাপক ভাঙচুর করে। হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও ডাক বাংলোতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। পাশাপাশি তারা ভূমি অফিসে অগ্নিসংযোগও করে। সহকারী কমিশনারের (ভূমির) গাড়িতেও তারা আগুন দেয়। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এলে হেফাজতের কর্মীরা ভূমি অফিসে প্রবেশে তাদের বাধা দেয়। পরে পুলিশের ধাওয়ার খেয়ে হেফাজত কর্মীরা মাদ্রাসা গেইটে অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধ করে বলে জানান ইউএনও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই শীলব্রত বড়ুয়া বলেন, হাটহাজারীর সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে পাঁচজনকে হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে চারজনকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, পুলিশের হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন। এরা সকলেই হেফাজতে ইসলামের কর্মী। তার ভাষ্য, নিহতদের নাম রবিউল, মেহরাজ, আবদুল্লাহ ও জামিল। তাদের মধ্যে তিনজন হাটহাজারি বড় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, একজন দর্জির কাজ করতেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশ ও হেফাজতকর্মীদের সংঘর্ষের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ব্যাপক তা-ব চালায় একদল মাদ্রাসা ছাত্র। গত শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই তা-ব চলাকালে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর চালায়। এ কারণে বিকালে ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম ও ঢাকাণ্ডসিলেট ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বলে আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি মাজহারুল করিম জানান। ওই ঘটনার পর সন্ধ্যায় শহর ও আশপাশ এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকালে বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা জেলা শহরের কাউতলি এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং ২ নম্বর পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে। তারা জেলা শহরের বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, আবদুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা, পৌর মার্কেট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এলাকায় টানানো ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ছিঁড়ে অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন স্থাপনাও তারা ভাঙচুর করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনের মাস্টার মো. শোয়েব আহমেদ বলেন, বিকালে কয়েকশ মাদ্রাসাছাত্র স্টেশনে এসে হামলা চালায়। এ সময় তারা টিকিট কাউন্টার, প্যানেল বোর্ড ও যাত্রীদের চেয়ার ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনে জিআরপি ফাঁড়িতেও হামলা হয় বলে ওসি মাজহারুল করিম জানান। সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করার পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান বলেন, মাদ্রাসাছাত্ররা মিছিল করে বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করেছে। এটিকে প্রতিরোধ করার জন্য আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়েছি। এদিকে ঘটনায় ১৪ জনকে আটক করে পুলিশ। জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয় বলে সদর থানার ওসি মো. আবদুর রহিম জানান। তবে আটককৃতদের নাম-পরিচয় বলেনি পুলিশ। ওসি রহিম বলেন, সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মোট ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে। জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।