কৃষি উৎপাদনে সেচ কার্যক্রমে সোলার পাম্পে কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছে না। অথচ সেচ মৌসুমে প্রতি বছরই জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। আর ডিজেলচালিত পাম্পের ব্যবহারন পরিবেশের দূষণ বাড়ে। ওসব সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বাপবিবো) ২ হাজার সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। আর ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে ব্যয়বহুল ওই প্রকল্প কোনো আবেদনই তৈরি করতে পারেনি। একেবারে শূন্যের কোটায় চাহিদা। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হলেও একটি পাম্পও স্থাপন করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ভেস্তে যেতে বসেছে প্রকল্পটি। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বাপবিবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রথমে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, নওগাঁ, ফেনী, কুমিল্লা-২, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ ওই ১০টি পল্লী উন্নয়ন সমিতির এলাকায় পাম্পগুলো স্থাপনের লক্ষ্য হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওসব অঞ্চলে কৃষকদের চাহিদা কম হওয়ায় নতুন করে ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মাদারীপুরসহ ৩২টি পল্লী উন্নয়ন সমিতির এলাকায় পাম্পগুলো স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্প স্থাপনের প্রকল্পটি বিগত ২০১৮ সালের ২৯ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পেয়েছিল। তাতে সরকারের অর্থায়ন ধরা হয়েছিল ৩৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। তাছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ ৩৬৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর প্রকল্পে বাপবিবোর নিজস্ব অর্থায়ন ধরা হয়েছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর আরো প্রায় তিন মাস সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা এখনো একটি পাম্পও স্থাপন করতে পারেনি। এ অবস্থায় আবারো প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প স্থাপন-সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) সংশোধনী উত্থাপন করা হয়। কিন্তু ওই সময় পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যয় ৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৪৫৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ধরা হয়েছে ৬৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এডিবির প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৮৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর বাকি ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বাপবিবো নিজেই অর্থায়ন করছে। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ সময় ২ বছর বাড়িয়ে আগামী বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের অধীনে একটিও পাম্প স্থাপন করা যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয়ের কারণে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
এদিকে বাপবিবোর কর্মকর্তাদের মতে, সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প ক্রয়ে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলতে প্রচার কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের অপারেশনাল মডেল পুনর্গঠন ও প্রকল্প এলাকা বাড়ানো হচ্ছে। ফলে প্রত্যাশা করা যায় আগ্রহী কৃষকের সংখ্যা বাড়বে। আর সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
অন্যদিকে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য এডিবি থেকেও তাগিদ দেয়া হচ্ছে। ওই কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হলে এডিবির সম্মতি ও ইআরডির মতামত নিতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক শাকিল ইবনে সাঈদ জানান, এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ডিজেলচালিত পাম্পগুলোকে প্রতিস্থাপন করে সোলারে চালানো হবে। কিন্তু এখন দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। তাই সোলার পাম্পে কৃষকের চাহিদা কমে গেছে। তবে এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আগে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কৃষকদের আকৃষ্ট করতে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছিল। কৃষকরা যাতে পাম্পগুলো নিতে আগ্রহী হয় সেজন্য কমিটি বেশকিছু সুবিধা দেয়ারও সুপারিশ করেছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ওসব সুপারিশের অন্যতম হচ্ছে পাম্পের মূল্যহ্রাস। আগে একটি ৩ অশ্বশক্তির পাম্প কিনতে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা লাগতো। এখন তা কমিয়ে ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা করা হয়েছে। আগে এককালীন পরিশোধ করতে হতো ১৫ শতাংশ। সেটা এখন তা ১০ শতাংশ করা হয়েছে। সেচকাজে ব্যবহারের পর যখন পাম্পগুলো অলস বসে থাকবে, তখন কৃষক জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে। সেজন্য পাম্প থেকে জাতীয় গ্রিডে সংযোগ স্থাপনের যাবতীয় খরচ সরকারই বহন করবে। তাই আশা করা যায় আগামীতে এ প্রকল্প কৃষকদের আকর্ষণ করবে। তারপরও বাস্তবায়নের দিক থেকে এটি একটি কঠিন প্রকল্প। কারণ বিদ্যুৎ এখন সব জায়গায় আছে। মানুষ বিদ্যুতের দামের সঙ্গে এর খরচের তুলনা করে দেখবে।