ঝিনাইদহের খোদ্দখালিশপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজ। কলেজ প্রাঙ্গনে হয়েছে তাঁর নামে এই গ্রন্থগার ও স্মৃতি জাদুঘর। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যে গ্রামে সিপাহি হামিদুর রহমানের জন্ম, তার নাম খোর্দ্দ-খালিশপুর। ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এ বীরের স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাদুঘর ও লাইব্রেরী। সেখানকার রাস্তাঘাট মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করে দিয়েছে। গ্রামের মানুষের শিক্ষাকে সহজ করেছে স্থাপিত স্কুল-কলেজ। যার ফলে দুরদুরান্তের বা শহরে গিয়ে শিক্ষা অর্জনের খোর্দ্দ খালিশপুর ছিল মহেশপুর উপজেলার একটি প্রত্যান্ত গ্রাম। গ্রামটি ছিল বেশ অপরিচিত। স্বাধীনতার পর গ্রামটি সারাদেশে বেশ পরিচিতি পায়। একজন বীরকে ধারণ করা গ্রামটি সবার কাছে সুপরিচিত হয়ে উঠে। তার গ্রামের বাড়ি দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে আগ্রহের েেকন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ বীরের স্মৃতি রক্ষার্থে সেই খোর্দ্দ খালিশপুরের নামও পরিবর্তন করা হয়। সেই গ্রামটির নামকরণ হয় হামিদনগর।
১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিবঙ্গের চব্বিশ পরগনার চরপাড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তার পরিবার ঝিনাইদহের মহেশপুরের খোর্দ্দ খালিশপুর (বর্তমান হামিদনগর) গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার বাবা আক্কাস আলী, মা কাইদাছুন নেছা। হামিদুর রহমানরা ৪ ভাই ও ৩ বোন।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের পরিবারের জন্য ১৯৮১ সালে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু বাড়িটি ধসে পড়েছিল। এখন সেই বাড়িটি চারতলা করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য বাড়িটির একতলা সম্পন্ন হচ্ছে। বাকি ভবনের তলার কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের একমাত্র জীবিত ভাই হামজুর রহমানের স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন প্রদানমন্ত্রীর শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের জন্য নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে। এ ভবন পেয়ে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের পরিবারের সবাই খুশী। সবাই এখানে থাকতে পারবে।
মহেশপুর উপজেলার খালিশপুর বাজারের কাছেই গ্রামটির অবস্থান। এখানে ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পাওয়া হামিদুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের রণাঙ্গণে শহীদ হন তিনি। গ্রামে তাঁর নামে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি কলেজ, যেটি পরে সরকারীকরণ হয়েছে। কলেজ প্রাঙ্গনে হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান গ্রন্থগার ও স্মৃতি জাদুঘর। ২০০৮ সালের শুরুর দিকে এটি উদ্বোধন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়) আনোয়ারুল ইকবাল।
চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে হামিদুর রহমান ছিলেন বড়। বাবার নাম মৃত আক্কাচ আলী। মায়ের নাম মৃত কায়দাছুন্নেছা। ভাই শুকুর আলী ও ফজলুর রহমান মারা গেছেন। অপর ভাই হামজুর রহমান বেঁচে আছেন। তবে শারীরিক ভাবে তিনি খুবই অসুস্থ। হামিদুরের দুই বোন রিজিয়া খাতুন ও আছিয়া খাতুনও জীবিত।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় বীরশ্রেষ্ঠের ভাতিজা হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁদের পরিবারটি ছিল খুবই অসচ্ছল। ভারত থেকে এসে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন তাঁরা। দাদা আক্কাচ আলী দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। বড় ছেলে হামিদুর রহমান ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কাজে যেতেন। ফলে বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেনি। খুবই সহজ-সরল মানুষ ছিলেন হামিদুর।
১৯৭০ সালে হামিদুর রহমান প্রথমে আনসার বাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর নৌবাহিনীতে চাকরি পান। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ওই চাকরিতে যোগদান করেন। এরপরই শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধ। দেশমাতৃকার টানে ওই যুদ্ধে যোগ দেন হামিদুর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাকে দেখার জন্য একদিন বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। তার কয়েক দিন পরই ছিল ঈদুল ফিতর। বলে গিয়েছিলেন ঈদের জন্য টাকা পাঠাবেন। সেই টাকা আর পাঠাতে পারেননি। মৌলভীবাজারের ধলই এলাকার রণাঙ্গনে শহীদ হন এই বীর সন্তান। ভারত সীমান্তের এলাকাটি জেলার সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানকার ধলই সীমান্ত ফাড়িটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী সেটি দখল করে নেয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। অক্টোবরের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ওই ফাড়িতে হামলা চালান। কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিলেন না। ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি এলএমজি ছিল প্রধান অন্তরায়। সেটি নিস্ক্রিয় করার দায়িত্ব পড়ে হামিদুর রহমানের ওপর। ২৮ অক্টোবর তিনি একাই অকুতভয়ে এগিয়ে গিয়ে ওই এলএমজি নিস্ত্রিয় করেন। কিন্তু সেটি নিস্ত্রিয় করতে পারলেও শত্রুর বুলেটে তিনি শহীদ হন।
ভাতিজা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তাঁরা চাচার শহীদ হওয়ার কথা জানতে পারেন। লাশটি সীমান্তের ওপারে ভারতের আমবাসা গ্রামে নিয়ে সমাধিস্থ করেছিলেন সহযোদ্ধারা। ৩৬ বছর পর তাঁর দেহাবশেষ ভারতের মাটি থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ১৯৮১ সালের ২৪ ডিসেম্বর হামিদুরের পরিবারকে একটি বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৩ কোটি টাকা অর্থায়নে সেই বাড়িটি ভেঙে বর্তমানে চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে একতলার কাজ শেষ হয়েছে। আর পরিবারটি প্রতি মাসে সরকারি ভাতা হিসেবে ৩৫ হাজার টাকা পায়। এই অর্থ পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নেন। হামিদুরের নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করেন তাঁর ভাতিজা মোস্তাফিজুর। হামিদুর রহমানের নামে গ্রামে কলেজের পাশাপাশি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। এ ছাড়া ঝিনাইদহ জেলা শহরের একটি স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।