সরাইল সদর ইউনিয়নের সৈয়দটুলা গ্রামের সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। বয়স ৪৪ বছর। ১৫ বছর ছিলেন প্রবাসে। শিক্ষক সৈয়দ শাহজাহানের বড় ছেলে তিনি। সংসারের সুখ ও পিতা মাতার মুখে হাঁসি ফুটাতে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রবাসে। ভালই চলছিল তাদের পরিবার। সর্বশেষ ৯ বছর আগে এসেছিলেন দেশে। বিয়ে করে কয়েক মাস পরই আবার চলে গেছেন। ফাঁকে কন্যা সন্তানের বাবা হলেন। একমাত্র কন্যা মাওয়ার বয়স এখন ৮ বছর। সন্তানের খবর শুধু কানেই শুনলেন। চোখে দেখেননি। কথা হয়নি। সন্তানকে ছুঁয়ে কোন দিন আদরও করতে পারেননি। এমন সব হাজারো চাওয়া অপূরণীয় রেখেই আনোয়ার গত ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে সৌদী আরবের রিয়াদের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেলেন পরপারে। তার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে শুধু পরিবার নয় শোকে কাতর হয়ে পড়েছে গোটা গ্রাম। একমাত্র মেয়ের মুখ আর দেখা হল না আনোয়ারের। বাবা কি? তা বুঝার বা অনুভব করা ভাগ্যে জুটল না মাওয়ার। বাস্তবতা বড়ই নির্মম। বিয়ের পর মাত্র ৩ মাস কাছে পেয়েছেন স্বামীকে। এরইমধ্যে বিধবার শাড়ি পড়তে হচ্ছে আনোয়ারের স্ত্রী রূমা আক্তারকে (৩৮)। ‘পিতার কাঁদে পুত্রের লাশ’ এমন কঠিন বাস্তবতার শিকার বৃদ্ধ পিতা শাহজাহান (৭০) বাকরূদ্ধ হচ্ছেন বারবার।
পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সরাইল উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন উজ্জ্বলের বড় ভাই আনোয়ার। ৫ ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। একমাত্র বোন জুঁই। মা মারা গেছেন অনেক আগে। সংসারের সুখের জন্য অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন সৌদী আরবে। চাকরির পাশাপাশি সেখানে ব্যবসাও করতেন। ভালই চলছিল আনোয়ারের দিনকাল। সাড়ে ৯ বছর আগে দেশে আসছিলেন। তখন সামাজিক ভাবে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছু দিন পরই আবারও চলে যান প্রবাসে। এরইমধ্যে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক হন। নাম রাখা হয় মাওয়া। শিশু মাওয়া পৃথিবীতে এসে বাবাকে দেখেনি। বাবার স্পর্শও পায়নি। তাই বাবা কি? সেইটা অনুভব করতে পারেনি মাওয়া। মাওয়ার বয়স এখন ৮ বছর। এরমধ্যে একবারও দেশে আসেননি আনোয়ার। একমাত্র কন্যাসন্তান জন্মের খবর শুধু কানেই শুনেছেন। সন্তানকে চোখে দেখেননি। কথাও হয়নি। বুকে জড়িয়ে আদর করার সুযোগও পাননি। সম্প্রতি প্রবাসে অসুস্থ্যতায় ভোগছিলেন আনোয়ার। গত ১৭ মার্চ দেশে পূর্ণ প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শাররীক অবস্থার অবনতি হলে সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৮ মার্চ দিবাগত রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরপারে চলে যান আনোয়ার। দেশে আসা ও মেয়ের সাথে দেখা করার ইচ্ছে অপূরণীয়ই রয়ে গেল তার। দীর্ঘ ৯টি বছর স্বামী আসার অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী রূমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। সরজমিনে আনোয়ারদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রবাসে সন্তান হারানোর বেদনায় কাতরাচ্ছেন পিতা শাহজাহান মিয়া। প্রিয় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদে কাঁদছেন ছোট দুই ভাই। শিশুকালে মা হারিয়ে পিতা ভাইদের আদরে বেড়ে ওঠা একমাত্র বোন জুঁই কাঁদছে অঝরে। কন্যা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বামী হারানোর বেদনায় স্ত্রী রূমার কান্নায় কাঁপছে আকাশ বাতাস। পরিবারের অন্য স্বজনদের মাঝেও চলছে শোকের মাতম। ভারী থেকে ভারী হয়ে ওঠছে ওই বাড়ির পরিবেশ। শান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলছেন স্বজনরা। চিকিৎসার সময় আনোয়ারের সাথে থাকা ছোট ভাই ইকবালকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি কি দেশে ফিরে স্বজনদের দেখে মরতে পারব না?’ তার আক্ষেপই শেষ পর্যন্ত সত্য হল। আনোয়ারের আরেক ছোট ভাই সৈয়দ ইসমাইল হোসেন উজ্জ্বল বলেন, জীবিত বাবাকে না দেখার বেদনা সারা জীবন তাড়া করে বেড়াবে মাওয়াকে। শিশু মাওয়া যেন পিতার নিথর দেহের মুখটা অন্তত একটি বার দেখতে পায়। তাই ভাইয়ের লাশটি দেশে আনার জন্য চেষ্টা করছি।