কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সুপেয় পানীর অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এসময়ের চৈত্র মাসের খরায় কয়েক হাজার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পল্লী অঞ্চলেরে সাধারণ নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। কিছু নলকূপে পানি উঠলেও এর কয়েকটি আবার আর্সেনিকযুক্ত। তাই অনেকেই নলকূপ তুলে ফেলেছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরাধীন কিশোরগঞ্জ জেলার হস্তচালিত নলকূপের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, জেলার তেরটি উপজেলায় মোট নলকূপ রয়েছে ৪১ হাজার ৯ শত ৭৭টি। মোট চালু রয়েছে ৩৮ হাজার ৮ শত ৯৬টি। মোট অকেজো রয়েছে ৩ হাজার ৮১টি নলকূপ। এছাড়াও অগভীর ও গভীর এবং গভীর তারা নলকূপও রয়েছে হাজার হাজার। এসব সরকারী নলকূপের পাশাপাশি জেলার প্রায় ৩৩ লাখ জনসাধারণের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবেও অসংখ্য নলকূপ রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের গোয়ালাপাড়া, নয়াপাড়া, চরপাড়া, কলাপাড়া, ভাষ্করখিলা, ভদ্রপাড়া, নাথপাড়া, কাশুরারচর, আগপাড়া, দরিয়াবাদ, চংশোলাকিয়াসহ ১৯টি গ্রামের মধ্যে ১০টি গ্রামের নলকূপে পানি না ওঠায় অকেজো হয়ে আছে। কোনো কোনো গৃহস্থ চুরির ভয়ে পাইপ থেকে নলকূপ খুলে ঘরে নিয়ে রেখেছেন। গৃহিণী ও কিশোরীরা কলসি কাঁখে দূরবর্তী নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। মসজিদের নলকূপে পানি না ওঠায় মুসল্লিরা অজু করতে পাশের ডোবার পানি ব্যবহার করছেন। এসব গ্রামে বর্তমানে ধোয়া-মোছার কাজে পুকুর কিংবা ডোবার পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে হেপাটাইটিস-বি, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব এলাকার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে। ফালগুন-চৈত্র-বৈশাখ মাসে খরার কারণে অবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে এলাকাবাসী জানান। বর্তমান অবস্থায় বলা যায়, দেড় মাস পর ৯০ শতাংশ নলকূপেই পানি উঠবে না। এ ব্যাপারে তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কারণ তখন হাতেগোনা কয়েকটি নলকূপ ছাড়া বাকিগুলোতে পানি উঠবে না।
ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের শাহ আলম, হুমায়ুন, মুশাহিদ জানান, আমাদের নয়াপাড়া গ্রামে লোকসংখ্যা দেড় হাজার। তার মধ্যে নয়াপাড়ায় সহ¯্রাধিক মানুষের বাড়িতে পানির কল নেই। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় পূর্বপাড়া গ্রাম থেকে এলাকার বাসিন্দাদের পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কয়েকটি বাড়ির পর একটি নলকূপে পানি পাওয়া যায়।
গোয়ালাপাড়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ রবিন জানান, আমাদের মসজিদের নলকূপটিতে পানি না ওঠায় নতুন করে বিকল্প পদ্বতিতে মুসুল্লীদের জন্য ওজুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার নিজের বাড়ির নলকূপেও পানি আসে না। একই গ্রামের বাদল মিয়া, দুলাল মিয়া জানান, গত পাঁচ বছর ধরে পানির স্তর নিচে নামছে। তাই আমাদের গ্রামের নলকূপে চৈত্র মাসে পানি আসে না। গ্রামের কলওয়ালা বাড়ির এনামুল হক বাবুল বলেন, বৃটিশ আমলে আমার পিতা আ.মতিন নায়েব অব এ গ্রামে জনস্বার্থে একটি নলকূপ বসিয়েছিলেন। এতে কয়েক গ্রামের মানুষ সুপেয় পানি পেতো। বর্তমানে সেটি অকেজো হয়ে গেছে। তাই নিজেরাই সাব মার্শিবল বসিয়ে পানির সংকট দূর করনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপরেও পানি কম আসে।
ভদ্রপাড়া গ্রামের জহিরুল ইসলাম রিপন বলেন, আমাদের বাড়িতে ৩টি নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে একটিতেও পানি আসে না।
মহিনন্দ ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনসুর আলী জানান, কয়েক বছর ধরে এ সমস্যা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পানযোগ্য পানির চরম সংকট চলছে। নলকূপের জন্য অনেকেই আবেদনপত্র ইউপি কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন। বরাদ্দ না দিলে আমাদের করার কিছু নেই।
চৌদ্দশত ইউনিয়নের পুর্ব জিনারাই গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম, বিল্লাল, বাচ্চু মিয়া বলেন, পরশু দিনের কালবৈশাখী ঝড়ে এমনিতেই আমাদের গ্রামের ধানী জমি গরম হাওয়ায় পুড়ে গেছে। এতে করে ধানে চিটা দেখা দিয়েছে। এরপরে নলকূপে পানি আসে না। ফলে আমরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছি।
যশোদল ইউনিয়নের বিষ্ণু বাড়ির বাবুল মিয়া, শরীফ মিয়া, বিল্লাল মিয়া বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আমাদের বাড়ির নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
বৌলাইয়ের মূল সতাল এলাকার মুবাশি^রুল হক নাদিম বলেন, আমাদের বাড়িতে সাব মার্শিবল নলকূপ তারপরেও পানি নিয়মিত আসে না।
কিশোরগঞ্জ পৌরসভার গাইটালের বাসিন্দা কাজল মিয়া বলেন, পৌরসভার পানির সাপ্লাই বন্ধ থাকায় আমরা গোসল করতে পারছি না। পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের বাগপাড়া এলাকার কাঞ্চন, মালেক, বাবুল বলেন, আমাদের এলাকায় সাপ্লাইয়ের পানি সমস্যা রয়েছে। নিজেদের নলকূপেও পানি আসে না। ফলে আমরা উভয় সংকটে রয়েছি।
কয়েকজন পৌর নাগরিক জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি বিষয়ে একটি আইনে উল্লেখ আছে পৌরসভার পানি ব্যতিত পৌর সভার কোন নাগরিক ব্যক্তিগতভাবে নলকূপ বসানোর ঝঠিলতা রয়েছে। ফলে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে নলকূপ বসাতেও পারছে না।
এব্যাপারে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পারভেজ মিয়ার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া যায়নি তবে পৌর সচিব মোঃ হাসান জাকির জানিয়েছেন, একটি আইন আছে যে পৌরসভার ভেতরে ভূগর্ভস্থ সকল পানির মালিক পৌরসভার। এই আইনটি অনেক আগেই করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে পৌর নাগরিককে নলকূপ বসাতে কোনো বাঁধা নেই। একটা সমস্যা রয়েছে ১ হাজার ফিটের গভীরে হতে হবে। এ কারণে অনেকে বসাতে চায় না। পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানির কিছুটা সমস্যা আগে ছিলো বর্তমানে কোনো সমস্যা নেই।
নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এক সময়ে মানুষ কূয়ায় পানি জমিয়ে রাখতো এখন টিউবওয়েলে পানি উত্তোলন করা হয়। এ সময় জেলার অধিকাংশ এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে যায়। বৃষ্টি না হওয়া এবং প্রচ- খরার কারণে এবার অবস্থা আগের চেয়ে প্রকট। বৃষ্টি হলে অবস্থার উন্নতি হবে বলে জানিয়েছেন।