বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সংসার চলত অভাব অনটনে। এমনকি তিনবেলা ঠিক মত খাবারও জুটতো না তাদের। স্বামী রাইহান রাজমিস্ত্রির জোগালের কাজ করেন। দুই ছেলে-মেয়েসহ চারজনের সংসারের স্বামীর সামান্য মজুরিতে চলে না তাদের সংসার। পরিবারের আয় সামলাতে ছেলিনা তার নিকটতম আত্মীয় বাড়ি থেকে কিছু টাকা ধার এনে পাকিস্তান, ব্রয়লার ও লেয়ার জাতাতের মুরগির খামার গড়ে তুলেছিলেন। এতে লাভের মুখ যেমন দেখেছিলেন, তার পাশাপাশি লোকসানের পরিমাণও কম ছিলোনা। তাই সেগুলো বাদ দিয়ে প্রায় দুই বছর আগে স্থানীয় এক বেসরকারি এসো সংস্থা থেকে খোঁজ পান পুষ্টি, ঔষধি গুণসম্পন্ন ও ভালজনক কালো রঙের কাদাকনাথ মুরগির। এই মুরগির খামার দিয়ে বদলে দিয়েছে মিসেস সেলিনার সংসার। ভারতের মধ্য প্রদেশের পুষ্টি, ঔষধি গুণসম্পন্ন ও ভালজনক মুরগি হিসেবে পরিচিত কাদাকনাথ খামার এখন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কাশিপুর গ্রামের গৃহবধূ সেলিনার নিজ বাড়িতে। তার মুরগির খামারে ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে পালন শুরু করেছেন তিনি।
সরেজমিনে দেখে গেছে, উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের গৃহবধূ সেলিনার নিজ বাড়িতে কাদাকনাথ মুরগির ব্যতিক্রমী খামার গড়ে তুলেছেন। ব্যতিক্রম এ কারণে যে, পোলট্রি খামারগুলোয় সাধারণত খাঁচায় মুরগি পালন করা হয়। কিন্তু মিসেস ছেলিনার মুরগি পালন করছেন উঠানে ও মাঠে ছেড়ে দিয়ে। তার বাড়িতে নানা জাতের মুরগি রয়েছে। তবে কালো মুরগিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যুগে যুগে কালোর কদর না থাকলেও কুচবরণ এই মুরগি এখন গুরুত্বের বিচারে কদর পাচ্ছে ছেলিনার কাছে বেশি। কুচবরণ মুরগির গুণের কোনো সীমা নেই। যার পালক, চামড়া, ঠোঁট, নখ, মাথার ঝুঁটি, জিব, হাড়, মাংস এমনকি নাড়িভুঁড়ি-সবই তার কালো। মাংস সুস্বাদু,ঔষধি গুণসম্পন্ন এবং লাভজনক এ ভিন্ন জাতের মুরগির আদি ঠিকানা ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের কেমানি নামক এলাকার। সেখানে এটাকে বলা হয় ‘আয়্যাম কেমানি’। তবে ভারতের মধ্য প্রদেশে কাদাকনাথ মুরগি রয়েছে। সেখানে এই মুরগি ‘কালোমাসি’ নামে পরিচিত। এই বিদেশী কাদাকনাথ বা কালো মুরগি এক অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিয়েছে ছেলিনার সংসারে। পোলট্রি উদ্যোক্তা ছেলিনা কাদাকনাথ জাতের মুরগি নিয়ে দেখছেন অনেক বড় স্বপ্ন। আর তার স্বপ্ন যে বাস্ততায় মিলছে, তা-ই যেন সত্যি মনে হলো। শুধু মুরগি পালন নয়, এক দিনের বাচ্চা উৎপাদনও শুরু করেছেন এই নারী উদ্যোক্তা। তারা খামারে বড় ও মাঝারি কাদাকনাথ মুরগি রয়েছে প্রায় ৭০টি। এর মধ্যে ২৫টি বড় কাদাকনাথ মুরগি রয়েছে। তার মধ্যে ৬টি মোরক ও ১৯টি মুরগি রয়েছে। বর্তমান প্রতিটি মুরগি বছরে গড়ে ১শ ৫০টি ডিম দিচ্ছে। তার নিজস্ব ইনকিউবেটরের মাধ্যমে প্রতি মাসে শত শত কাদাকনাথ মুরগি বাচ্ছা উৎপাদন করছে। অন্যান্য পোলট্রি মুরগির মতোই ২১ থেকে ২২ দিনে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করছেন ছেলিনা। প্রতি মাসে প্রায় ৪শ বাচ্ছা উৎপাদন হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতি মাসে প্রায় ৪০০টি নতুন বাচ্চা যোগ হচ্ছে ছেলিনার খামারে। আর প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০০টি বাচ্চা বিক্রি করেছেন তিনি। তার খামারে নতুন প্রজাতির মুরগি দেখতে প্রতিদিনই উৎসুক নারী-পুরুষের ভীড় করছেন।
সেখানে গৃহবধূ সেলিনার কাছে জানতে চাইলাম কুচকুচে কালো রঙের কাদাকনাথ মুরগির সম্পর্কে, তিনি বললেন, বর্তমানে পোলট্রি ব্যবসায় যে ধস নেমেছে তার মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে খাদ্য খরচ বেশি। পাকিস্তান ব্রয়লার ও লেয়ার জাতের মুরগির খামার দিয়ে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক কম। তাই মনে মনে ভাবছিলাম নতুন কিছু করবো। প্রায় দুই বছর আগে স্থানীয় এক বেসরকারি এসো সংস্থা থেকে খোঁজ পেলাম পুষ্টি, ঔষধি গুণসম্পন্ন ও ভালজনক কালো রঙের কাদাকনাথ মুরগির। সেই সংস্থা থেকে ২২ দিনের বয়সের কাদাকনাথের বাচ্ছা ৩০টি বাচ্ছা নিয়ে পালন করলাম। কাদাকনাথের বৈশিষ্ট্য হলো, এর পালক, চামড়া, ঠোঁট, নখ, মাথার ঝুঁটি, জিব, হাড়, মাংস এমনকি নাড়িভুঁড়ি-সবই তার কালো। আর খাদ্য খরচ একেবারেই কম। এমনকি কাঁচা ঘাসও বেশ স্বচ্ছন্দে খেয়ে নেয়। এই মুরগি পালন করছি উঠানে বাঁশের মাচায় করে এবং মাঠে ছেড়ে দিয়ে। অন্য যে কোনো মুরগির চেয়ে এই মুরগি পালনের তেমন ঝামেলা নেই। এই মুরগির উৎপাদন ব্যয় অনেক কম এবং অল্প বিনিয়োগে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা করা যায়। এই মুরগি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক বেশি।
মিসেস সেলিনা আরও বলেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক কাদাকনাথ মোরগের ওজন হয় তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি এবং মুরগির ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি হয়ে থাকে। বড় মোরগের দাম প্রায় দু-হাজার টাকা এবং বড় মুরগির দাম প্রায় দেড় হাজার টাকা। এই মুরগি সৌখিন হিসেবেই মানুষ খায়। খাওয়ারের জন্য মানুষ মোরগ বেশি কেনেন। এই মুরগির মাংসে পুষ্টি উপাদান রয়েছে অনেক বেশি। ডিম ও মাংস খেতে খুব সুস্বাদু এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন মাংস। এই মুরগি ছয় মাস বয়সে প্রতিটি মুরগি বছরে ১৩০ থেকে ১৫০টি ডিম পাড়ে। তবে, এই মুরগি ডিমে তা দেয় না। বাচ্চা ফোটাতে দেশি মুরগির নিচে তা দেয় হয়। কিংবা ইনকিউবেটরে কৃত্রিমভাবে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানো হয়। এক মাস বয়সের বাচ্চা ৩শ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা দামে বাজারে বিক্রি হয়। বর্তমার বাজারে এই মুরগির বাচ্ছা চাহিদার অনেক বেশি। বাচ্চা নিতে হলে মাস খানেক আগে অর্ডার দিতে হয়। আমার কাছ থেকে প্রায় দিনে বাচ্চা কেনে নিয়ে যায় অনেক খামারি। তারাও নতুন করে পালন করছেন। এই মুরগি পালন করে সংসারে অনেক আর্থিক স্বচ্ছতা এসেছে।
উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.ওয়াজেদ আলী মন্ডল দাদা বলেন,সরকারি নানা উদ্যোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বে-সরকারি উদ্যোগে সাধারণ মানুষসহ গৃহবধূ সেলিনারমতো ভাগ্য পরিবর্তনের এমন চেষ্টা প্রশংসার দাবিদার।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মো. আবু তালেব বলেন, মাংস সুস্বাদু,ঔষধি গুণসম্পন্ন এবং লাভজনক এ ভিন্ন জাতের মুরগির আদি ঠিকানা ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের কেমানি নামক এলাকার। সেখানে এটাকে বলা হয় ‘আয়্যাম কেমানি’। তবে ভারতের মধ্য প্রদেশে কাদাকনাথ মুরগি রয়েছে। এই বিদেশী কাদাকনাথ বা কালো মুরগি পুষ্টিগুণ বিবেচনায় অন্য সব মুরগির চেয়ে এগিয়ে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, যৌন দুর্বলতা এমনকি ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য কাদাকনাথ মুরগির মাংস এবং ডিম খুব উপকারী। এই মুরগির মাংসে কোলেস্টেরল কম থাকে। কাদাকনাথের মাংস ভিটামিন বি১, বি২, বি৬, বি১২, সি, ই, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও এ্যামিনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ। কালো মুরগির মাংস শিশুদের দৈহিক গঠনের জন্য অনেক উপকারী। অন্য সব মুরগির চেয়ে কাদাকনাথ মুরগি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি ফলে চিকিৎসা খরচও অনেক কম। নিয়মিত টিকা ব্যবহার করলে খামারিকে অন্য কোন ওষুদের জন্য বাড়তি ব্যয় করতে হবে না। কাদাকনাথ মুরগি পালনে স্বল্প ব্যয়, স্বল্প পরিশ্রম ও স্বল্প সময়ে অধিক আয় নিশ্চিত করা যায়। ফলে বাজারে এর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। আর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের গৃহবধূ সেলিনার নিজ বাড়িতে কাদাকনাথ মুররি খামার দিয়ে বড় একটি ভূমিকা রেখেছেন। এর ফলে তার দেখাদেখিতে এলাকায় নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ও দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অবদান রাখার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি।