মণিরামপুরের মাঠে মাঠে বোরো ধানগাছে যেভাবে সোনালী বর্ণের বাইলগুলো দুলছে তাতে কৃষকের মুখে হাঁসির ঝিলিক দেখা দিয়েছে। অনেক কষ্টের ফসল বোরো ধান নিয়ে কৃষক-কৃষাণীদের মাঝে যেমন আনন্দ উৎফুল্ল বিরাজ করছে, অপরদিকে কালবৈশাখী ঝড় নিয়েও তাদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশে কৃষকরা যদি ধান বাড়িতে তুলতে পারে তাহলে অতীতের সকল রেকর্ড এবার ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি ধান এবং বিছালির বাজার মূল্যে যদি ধ্বস না-নামে সেক্ষেত্রে কৃষাণ-কৃষাণীদের সোনালী স্বপ্ন পূরণ হবে।
খাটুয়াডাঙ্গা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বলেন, নিজের ব্যবসার পাশাপাশি অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে এবছর ৩ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। ধানের ফলনও আশানুরূপ হয়েছে। ৪২ শতক বিঘার এ ৩ বিঘা জমিতে যেভাবে ফলন দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সকল খরচ-খরচা বাদ দিয়েও ধান এবং বিছালি বিক্রি করে এবার ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লভ্যাংশ হাতে থাকতে পারে। আর ধান এবং বিছালির বাজার মূল্য যদি এভাবে না থাকে সেক্ষেত্রে লাভের অংশ হয়তো একটু কমে যাবে, তবে লোকসান হবেনা। এ ছাড়া তিনি আরও জানান, প্রতিনিয়ত আকাশ যেভাবে মেঘাচ্ছন্ন হচ্ছে তাতে ধান বাড়িতে তোলা নিয়ে অনেক শঙ্কার মধ্যে রয়েছি। ধান পাকার মূহুর্তে যদি কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ি তাহলে আমাদের সকল আশা ভেস্তে যাবে।
উপজেলার আম্রঝুটা গ্রামের রিজাউল ইসলাম বলেন, এবার ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। প্রতিবিঘা জমিতে হালচাষ থেকে শুরু করে রোপন, নিড়ানি, সার, কীটনাশক, কাটা, বাঁধা, আনা, ঝাড়াই-মাড়াই এবং শ্রমিকের মুজরী বাবদ খরচ প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। সে মোতাবেক ৫ বিঘা জমিতে নিজের শ্রমবাদে মোট খরচ প্রায় ৮০ হাজার টাকা। তবে, ধানের বাজার মূল্য যদি মণ প্রতি নুন্যতম ১ হাজার টাকা এবং বিছালি কাউন প্রতি ২/৩ হাজার টাকা হয় তাহলে মোট মিলে প্রায় দেড়লক্ষ টাকা মুনাফা আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ধান ক্ষেতে পোকার আক্রমণ এবং খরা কম থাকায় মাঠে সকলের জমিতে ফলন খুবই ভালো হয়েছে।
সিরাজুল এবং রিজাউল ইসলামের মতো কাজিয়াড়ার মুরাদ হোসেন, আম্রঝুটার আবদুস ছামাদ, মিজানুর রহমান, সবুজ হোসেন, খেদাপাড়ার আবদুর রাজ্জাক, মুন্সিখানপুরের শাহজাহান আলী, এনায়েতপুরের আবদুস ছালামসহ আরও অনেকেই এমন আশার কথা শুনিয়েছেন। তারা আরও বলেন, বাজার মূল্য যেভাবে রয়েছে তাতে আবহাওয়া যদি প্রতিকূলে না-যায় এবং সুষ্ঠভাবে ধান ঘরে তুলতে পারি তাহলে বিগত বছরের তুলনায় এবারই বেশি চাহিদা মোতাবেক লাভের অংশ ঘরে আসবে।
উপজেলা কৃষি অফিস তথ্যমতে, মণিরামপুরে ১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ২৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর বোরো ধানের আবাদের মধ্যে রোহিতা ইউনিয়নে ১ হাজার ৬৩০, কাশিমনগর ৯৫৫, ভোজগাতী ৭৫৪, ঢাকুরিয়া ১ হাজার ৮৭০, হরিদাসকাটি ১ হাজার ৭১০, মণিরামপুর ৬৯৫, পৌরসভা ১ হাজার ৬০, খেদাপাড়া ২ হাজার ৩২০, হরিহরনগর ১ হাজার ৭২, ঝাঁপা ২ হাজার ২৬০, মশ্মিমনগর ১ হাজার ৮৫০, চালুয়াহাটী ১ হাজার ৭৭০, শ্যামকুড় ১ হাজর ৮৮৩, খানপুর ১ হাজার ৮২০, দূর্বাডাঙ্গা ১ হাজার ৮৮০, কুলটিয়া ৫৬০, নেহালপুর ৮৯৫ ও মনোহরপুর ইউনিয়নে ১ হাজার ২৯০ হেক্টার জমিতে এবারে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। তবে, মণিরামপুরের বোরো ধানের আবাদে এবার শীর্ষে রয়েছে উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়ন। আর জলাবদ্ধতার কারণে সবথেকে পিছে পড়েছে উপজেলার কুলটিয়া ও নেহালপুর ইউনিয়ন দুইটি।
উপজেলার কুলটিয়া ইউনিয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা অনাথ কুমার দাস এবং নেহালপুর ইউনিয়ন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা এস এম শফিউল আলম জানান, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মরণফাঁদ ভবদহ গ্রাসের কারণে ইউনিয়ন দু’টির নিন্মাঞ্চলগুলো এ বছর পানিতে প্লাবিত থাকায় বিগত বছরের তুলনায় বোরো ধানের আবাদ একটু কম হয়েছে। তবে ভবদহ দিয়ে যদি সঠিক সময়মতো পানি নিষ্কাশন হতো তাহলে কৃষকদের এমন দুশঃচিন্তার পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। এরপরও যেসব এলাকায় বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে সেসব এলাকায় চাষিদের মুখে হাঁসি ফুটেছে।
খেদাপাড়া ইউনিয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন বলেন, উপজেলার সবচেয়ে বেশি বোরো ধানের চাষ হয়েছে এই ইউনিয়নটিতে। ২ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে চাষ করা প্রত্যেকটি গ্রামের খাল-কুড়, মাঠঘাট, বিল এবং পতিত জায়গার ধানগাছগুলো সমানতালে পাক ধরেছে এবং সোঁনালী বাইলগুলো ঝুলছে। দেখলে যেন মনে হচ্ছে মণিরামপুরের মাঠে মাঠে পাকা ধানের বাইলগুলো যেভাবে দুলছে তাতে কৃষকের মুখে হাঁসির ঝিলিকের স্বপ্ন দেখা দিয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসান জানিয়েছেন, মণিরামপুর উপজেলায় এ বছর ২৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। যা টার্গেটের তুলনায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ কম হয়েছে। তবে, স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে বিল কপালিয়ায়, কুমারঘাটা বিল, বিল বোকড়, বিল কেদারিয়ায়, কুড়ামারা বিল ও হরিণা বিলে মোট ৪’শ হেক্টর জমি জলাবদ্ধ থাকায় কৃষকরা বোরো ধানের আবাদ করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, মণিরামপুরে কৃষক ভাইয়েরা ধান ঘরে তুলতে যদি কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে না-পড়ে তাহলে এবছর বোরো ধানের আবাদে আতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।