প্রচন্ড ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় আমি যে ৩৪ জন গুণি মানুষকে নিয়ে বই লিখেছি এবং সেই বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, বঙ্গবন্ধু প্রেমিক শামসুজ্জামান খান তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে নিয়ে আমার লেখা বই ‘শামসুজ্জামান খান : নিরন্তর সাহিত্যজন’ ২০১৮ সালে সরাসরি দিতে গেলে বলেছিলেন, ‘নতুনধারার রাজনীতিই শুধু করছো না, লিখছোও তো দারুণ।’
এমন প্রেরণার হাত ধরে পরে আরো দৃঢ়তার সাথে লেখালেখি করতে থাকি। লোকসাহিত্যে তিনি অনেকের চেয়ে অগ্রজ ভূমিকা রেখেছেন বলে আমি প্রায়-ই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতাম। ১৯৯৯ সালে তাঁর সাথে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চল মেহেন্দীগঞ্জ থেকে উঠে আসার মত দুঃসাহস যেহেতু দেখিয়েছো, আমি মনে করি- সফলতা তোমার আসবেই। আরো পড় এবং আরো লেখো।’
এমন প্রেরণা ছিলো বলেই আজ যখন তিনি চলে গেলেন, নতুন প্রজন্মের অন্যান্য প্রতিনিধিদের চেয়ে ভিন্নভাবে লিখছি- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন চলমান সময়ে। কিন্তু তারও অনেকে আগে থেকেই জাতির পিতাকে নিয়ে অনেক কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। আর এই কাজটি চলতি সময়ে অনেকে ক্ষমতার ভাগিদার হওয়ার জন্য করলেও বরেণ্য লোকসাহিত্যিক শামসুজ্জামান খান করেছেন নিরন্তর ভালোবাসা-শ্রদ্ধা থেকে। সেই ভালোবাসা নিয়ে আমাদের দেশের বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, অসীম সাহা, রবীন্দ্র গোপ, প্রত্যয় জসীম কবিতা লিখেছেন, ছড়া লিখেছেন ছড়াকার অন্নদাশংকর রায়, সুফিয় কামাল, ফয়েজ আহমেদ, ফারুক নওয়াজ, মোমিন মেহেদী, প্রবন্ধ লিখেছেন গবেষক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, নূহ উল আলম লেনিন, ড. একে আজাদ চৌধুরী প্রমুখ আর গল্প লিখেছেন কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন, শান্তা ফারজানা প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লিখতে লিখতে এগিয়ে গেছেন সাহিত্যজনগণ। এই ধারায় আমাদের সামনে উঠে এসেছে ছন্দিত স্মৃতিকথা। আমরা দেখেছি যারাই লিখেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে, তারাই তুলেছেন সম্মান ও শ্রদ্ধাকথা। কেউ কেউ তুলে এনেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতির সেই সোনালী সময়কে।
শামসুজ্জামান খান তাঁর স্মৃতির হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সাল। হঠাৎ করেই সুযোগ হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের। তারিখ মনে আছে, লেখাও আছে ডাইরিতে। ৩ রা ফেব্রুয়ারির সকাল নটা। তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হয়েছে। আমরা ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হলাম। বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম, লেখক-সাংবাদিক ও আমাদের বন্ধু রাহাত খান, আমি আর বাংলা একাডেমীরই সংস্কৃতি বিভাগের জনাব ম. জিল্লুর রহমান।
তার নিজের বৈঠকখানায় তখন অনেক লোক। বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি পরা, পাঞ্জাবি গায়ে, তার ওপরে বাদামী রংয়ের একটা শাল জড়ানো; হাতে পাইপ আর তার প্রিয় এরিনমোর তামাকের কৌটা। আমাদের দেখে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিশাল মানুষটির মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভওে গেল। অন্যদের বললেন, না, আজ আর কোনো কথা নয়, তোমরা আস এখন, আমি এদের জন্যে সময় দিয়ে রেখেছি। এদের সঙ্গে নিরিবিলতে কিছু জরুরি আলাপ করবো।’ বৈঠকখানা ভর্তি লোক ইচ্ছায় অনিচ্ছায় নিষ্ক্রান্ত হতে থাকলেন। তিনি বললেন, না, এখানে বসবো না। তাহলে কেউ না কেউ আসবেই। আমি মন খুলে কিছু কথা বলতে চাই।’
তাকে খুব সুন্দর আর প্রাণবন্ত লাগছিলো। তিনি উঠলেন। ধিরে এগুলেন ডানদিকে তার পাঠকক্ষের দিকে। আমরা তাকে অনুসরণ করছি সম্মোহিতের মতো। পাঠকক্ষের ভেতরে এসেব একটা আলমারির সামনে দাড়ালেন এবং অভ্যস্ত হাতে বের করলেন মাও সেতুংয়ের একটা বই। তার ঘুরে দাড়ালেন ডঃ ইসলামের দিকে। মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, শুধু রবীন্দ্রনাথ না, আমি নজরুল সুকান্ত এমনকি মাও সেতুংয়ের রচনাও মনোযোগ দিয়ে পড়ি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে চীনের ভূমিকা তো...। তিনি সে কথা শেষ করতে দিলেন না। বললেন- দুটো বিষয় তো আলাদা। মাও একজন খুব বড়ো নেতা। জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন। তার জীবন ও চিন্তাটা জানা ও বোঝা দরকার। একটা অনুন্নত বিশাল দেশকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সে দেশটায় এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কত উন্নত হয়েছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।’
এত সুন্দর স্মৃতির বুনন নিয়ের শামসুজ্জামান খান প্রমাণ করেছেন যে, জীবনকে তিনি নিবেদন করেছেন কেবলই সাহিত্যর জন্য। যেখানে নতুন আলোর সাথে সাথে স্বপ্ন নয় বাস্তবতা এসেছে স্মৃতির সাথে সাথে। আর তাই তিনি এগিয়ে গেছেন সুন্দরকে সাথে করে। লিখেছেন, ‘হঠাৎ তার মুখে একটু বেদনার ছায়া পড়লো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপরে বললেন- রাজনীতি বড় জটিল, নিষ্ঠুর। এর ফলে কত অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তা না হলে চীন আমাদের সমর্থন না করার কোনো যুক্তিই নেই। চীন খুব অন্যায় কাজ করেছে। যাক গে, আসুন প্রফেসর সাহেব, বসে বসে কথা বলি।’ বঙ্গবন্ধু বসলেন, প্রফেসর ইসলাম এবং আমরাও বসলাম। তিনি বললেন- বলুন প্রফেসর কী মনে করে এসছেন?’ ড. ইসলাম বললেন- বঙ্গবন্ধু, আমরা বাংলা একাডেমী থেকে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করছি, বিভিন্ন দেশ থেকে বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আসবেন। আপনাকে সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে পেতে চাই।’ তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! তার প্রত্যুত্তর ঃ আমি সাহিত্যের কি বুঝি! আমি কি বলবো! একজন প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বা পন্ডিতকে দিয়ে এ কাজ করান, সম্মেলনের মর্যাদা বাড়বে। আগে তো তাই হতো। ছাত্র জীবনে দু’একবার সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। কই রাজনৈতিক নেতারা তার উদ্বোধন করেছেন বলেতো মনে পড়ে না’। এই বলে তিনি হাসলেন, পরিস্থিতিকে একটু সহজ করার জন্য বললেন- আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাকে, সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই। এই পুঁজি নিয়ে দেশে-বিদেশের বড়ো বড়ো পন্ডিত ও সাহিত্যিক-শিল্পীদের মধ্যে যেতে আমি সংকোচবোধ করছি।’
তাকে বলা হলো ঃ এটা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন। এর একটা ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। আপনি সম্মেলন উদ্বোধন করলেন তা আন্তজার্তিক মর্যাদা লাভ করবে । তাছাড়া গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকতার প্রশ্নে আপনার ও আপনার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন ঘটবে।’ তিনি একটু ভাবলেন, বললেন- ঠিক আছে, যাবো। আমার বন্ধু জসীম উদ্দীন ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকেও বিশেষ মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানাবেন। আর একটা ছোট ভাষণ প্রস্তুত করে আমাকে দেখিয়ে নেবেন।’
ড. ইসলাম খোন্দকার মোহাম্মদ ইলয়াস, সন্তোষ গুপ্ত, রাহাত খান ও আমি সেই ভাষণটি প্রস্তুত করি। যা-হোক, সম্মেলন প্রসঙ্গ স্বল্প সময়ে বেশ করে তিনি বললেন, আপনারা সাহিত্যিক-সাংবাদিক, সংস্কৃতি-কর্মী ও গবেষক। ভবিষ্যতে আপনার হয়তো মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশ নিয়ে লিখবেন, তাই আমি আজ কিছু কথা বলতে চাই।’ তিনি ‘বাংলাদেশ’ নাম কীভাবে ঠিক করেছিলেন, দেশকে স্বাধীন করার চিন্তা তিনি যে সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই শুরু করেন সে কথাও বললেন। ‘সোনার বাংলা’ কে জাতীয় সঙ্গীত করবেন এ স্বপ্ন তার বুকের ভেতরে আলোর মতো জ্বলতো। এ গান শুনলে তিনি রোমাঞ্চিত, আবেগাপ্লুত হতেন, তাও জানালেন। ঠিক মনে পড়ছে না, রাহাত খান অথবা আমি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা তুললাম। তিনি আবার হাসলেন। বললেন- কিসের ষড়যন্ত্র! বলো, আমাদের স্বাধীনতার প্রয়াস।’ এরপর এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত বিবরণ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তার সার কথা এ রকম- আগরতলায় আমি ঠিকই গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিলো। একটু জ্বরও হয়েছিলো। অনেকটা পথ হেটে যেতে হয়। আমার পা ফুলে গিয়েছিলো। তবে নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়।’
একজন মানুষ কতটা সাবলিল আর সুন্দর লেখনির অধিকারী হলে এত সুন্দর করে সম্মান জানাতে পারেন, তা কেবলমাত্র একজন লেখক-ই বুঝতে পারে। বুঝতে পারে সাহিত্যময় বর্তমান। মানুষের সকাল যেমন নতুনভাবে ভোরের আলোর সাথে মিশে, ভোরের ¯িœগ্ধতার সাথে মিশে, সুন্দরের সাথে মিশে আসে; তেমনি শামসুজ্জামান খানের স্মৃতিকথাওআসে। এখানে শিক্ষণীয় বিষয় আছে, আছে অতিতের আয়না। এই আয়নায় মুখ রাখলেই দেখা যাবে জীবনযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের মুখ আর দেশের-মানুষের আবহমান দেহ। বাংলাদেশের স্থপতিকে নিয়ে অবিরাম কাজ করে যাওয়া অনন্য মানুষ শামসুজ্জামান খান চলে গেলেন ওপারের ডাকে। বিশ^জুড়ে যখন নির্মম মহামারি করোনার আঘাত; তখন লকডাউন কবলিত বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে শুভ বাংলা নববর্ষ, ধর্মীয়ভাবে ভাবগাম্ভির্যের মাহে রমজানের প্রথম দিন ১৪ এপ্রিল তাঁর এই চলে যাওয়া আমাদেরকে কেবল শোকাহতই করেনি, একজন নিমগ্ন দেশ-মানুষ-বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক-এর অগণিত কাজ থেকেও বঞ্চিত করেছে। সবাইকেই চলে যেতে হবে, বিনয় ভালোবাসায় আলোআশায় সেই চলে যাওয়ার পথ ধরে স্মরণিয় হয়ে থাকুক কাজগুলো লোভ মোহহীন নিরন্তর...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি