কয়লা সঙ্কটে এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন নিয়েই বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা হয়েছে। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুই ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ থাকায় লো-ভোল্টেজের পাশাপাশি ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বড়পুকুরিয়াই হচ্চে দেশের উত্তরাঞ্চলে এখনো বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় সক্ষমতার কেন্দ্র। ফলে ওই কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু করা না গেলে ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা এবং সেচকাজ ব্যাহত হবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) চলমান সেচ মৌসুম ও আসন্ন রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের উত্তর জনপদে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং লো-ভোল্টেজ কমাতে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কয়লা সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইফনিটই বছরের বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। দুই বছর আগে ওইসংকটের শুরু হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে ইউনিট দুটি চালু রাখার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন নিয়েই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মতে, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করা না গেলে সেচ মৌসুমে লোডশেডিং হবে। একই সঙ্গে লো-ভোল্টেজের কারণে কারখানার মেশিনারিজের পাশাপাশি উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্র জানায়, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৫২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার মোট ৩টি ইউনিট রয়েছে। তার মধ্যে ১২৫ মেগাওয়াটের দুটি এবং ২৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি ইউনিট। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের বেশকিছু এলাকায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বিগত ২০১৮ সালের ১৯ জুন বড়পুকুরিয়া খনি থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যায়। ফলে কয়লা সংকটে ওই বছরের ২২ জুলাই থেকে কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আর কখনো পূর্ণ মাত্রায় চলতে পারেনি। তবে কয়লা উধাও হওয়ার ঘটনার প্রায় ৫ মাস পর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আংশিকভাবে চালু করা হয়। ওই সময় কয়লা সংকটের কারণে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে উত্তরের চার জেলা রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে ওসব জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল সেগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন সিরাজগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হলেও এখনো বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
সূত্র আরো জানায়, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ইউনিটটি চালু থাকলেও পিডিবি তা থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নিতে পারছে না। এখন দৈনিক ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় গ্রিড থেকেও বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু দূরবর্তী কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিলে তাতে লো-ভোল্টেজ তৈরি হচ্ছে। যা শিল্প-কারখানা কিংবা মেশিনারিজে প্রভাব ফলে। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলে বড়পুকুরিয়া ছাড়া বড় ধরনের আর কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। আর ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কোনো একটি অচল হয়ে পড়লে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে রংপুর অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহে মোট ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে। তার মধ্যে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি ইউনিট বাদে বাকিগুলো ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার নিচে। ফলে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে বড়পুকুরিয়ার ওই ৩ ইউনিটের গুরুত্ব অপরিসীম। এমন পরিস্থিতিতে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে কেন্দ্রটির ৩ নম্বর ইউনিট চালু রাখার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৮০-২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হবে। কিন্তু কয়লার মোট মজুদ রয়েছে আড়াই লাখ টন। ওই পরিমাণ কয়লা দিয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পিডিবি ইউনিটটি চালাতে পারবে। কিন্তু তারপর ওই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হবে সংস্থাটির কাছে তার কোনো রূপরেখা নেই।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বড়পুকুরিয়া দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে এখনো একক ভূমিকা পালন করছে। উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে বড়পুকুরিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এখনো তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী। সরকার যদি ওই কেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দ্রুত নির্ধারণ না করতে পারে, তাহলে বড়পুকুরিয়ার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। বড়পুকুরিয়া কেন্দ্রটির উৎপাদনে থাকার চেয়ে বড় সমস্যা হলো ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে, তা কয়লা উত্তোলনের ওপর নির্ভর করে করার কথা ছিল। কিন্তু ওই মডেল না মেনেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল। ফলে সমস্যা যে প্রকট হবে তা তো স্বাভাবিকই।
অন্যদিকে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গে বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হুসাইন জানান, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ থাকলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তার পাওয়ার সেল তার একটি রূপরেখা আগেই করে রেখেছিল। কয়লা না পেলে মজুদকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলবে। ওই অনুযায়ী রেশনিং করে কেন্দ্রটি চালাতে হচ্ছে। পাওয়ার সেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী মজুদকৃত কয়লা দিয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলবে। তবে সরকার বড়পুকুরিয়া নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করছে। নতুন ফেজে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালানো সক্ষম হবে। তবে নতুন ফেজে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য নেই।
এ প্রসঙ্গে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পিডিবির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। বাকি দুটি ইউনিটের মধ্যে প্রথম ইউনিটটি রমজানের আগেই চালু করার রয়েছে। তা নিয়ে কাজ চলছে। তবে দ্বিতীয় ইউনিট কবে চালু হবে সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। বর্তমানে কেন্দ্রটির কয়লার সংকট রয়েছে। তবে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে তা দিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলবে।