মানবজীবনে সুখ-দুঃখ যেমন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তেমনি সুখ-অসুখ ও স্বাভাবিক বিক্রিয়া। একসময় রোগ বা অসুখ হবে আবার তা থেকে মুক্তি মিলবে এটা চিরন্তন সত্য। এর মাঝে জটিল-কঠিন রোগে কিছু সংখ্যক মারা যায় এটাও সত্য। তবে কার কখন মৃত্যু আছে সেটা কি কেউ জানি? আর যা জানি না তা আমার মতে না ভাবাই ভালো। কথায় আছে মরণকে জয় করতে পারলেই বেঁচে থাকা যায়। তাই মরণ থাকলে হবে এই ভেবে শক্ত ও সাহস করলে মনে হয় ইতিবাচক কিছুই হয়। তারপরও কিছু কিছু বিষয় কিন্তু সেই চেতনাকে বিলুপ্ত করে দেয়। দেখা দেয় ঘোর সংকট। হারিয়ে যায় সাহস ও বল। তেমনি একটি ভাইরাসের বিষয় হয়ত কাজ করছে অনেকের মধ্যে। তার নাম হলো করোনা ভাইরাস। এক বছরের বেশি সময় ধরে অব্যাহত রয়েছে এই ভাইরাস। আসুন জেনে নেই এই ভাইরাসের জীবনবৃত্তান্ত। করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর এই ভাইরাসের কবলে পরে বিশ্বের দুইশটিরও বেশি দেশ। ভেঙ্ েযায় বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। ১৬ এপ্রিল শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় প্রাণ হারালেন মোট ১০ হাজার ১৮২ জন। মহামারি করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ১৬ এপ্রিল ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১০১ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫৯, চট্টগ্রামে ২০, রাজশাহীতে ৩, খুলনায় ৫, বরিশালে ৪, সিলেটে ১ জন, রংপুরে ৬ জন ও ময়মনসিংহে ৩ জন রয়েছেন। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মারা যাওয়া ১০১ জনের মধ্যে ৬৩ জনেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ২৩, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৮ এবং ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৭ জন রয়েছেন। আর একই দিনে প্রাণঘাতি ভাইরাসটি ধরা পড়েছে ৪ হাজার ৪১৭ জনের শরীরে। শুক্রবার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে এসব জানা গেছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) ৯৪ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তার আগে সর্বাত্মক লকডাউনের প্রথম দিন ৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দেশে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৭ লাখ ১১ হাজার ৭৭৯ জন। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। আর প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে করোনা পরিস্থিতি। কিন্তু এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। মধ্যে কয়েক মাস ধরে শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু মার্চ থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত বছরে এত মৃত্যুর সংখ্যা দেখেনি দেশ। তবে এ বছরই আক্রান্ত ও মৃত্যু রেকর্ড হারে বাড়তে থাকে।
আমরা জানি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো হলো- এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও শুষ্ক কাশি হতে পারে। এর সপ্তাহখানেক পর শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। অনেক সময় নিউমোনিয়াও হতে পারে। তবে নতুন এই করোনাভাইরাস যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এ ভাইরাস থেকে নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় সঙ্কটের এই সময়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজেকে ও আশেপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা । একবছর আগে ্পরামর্শ দিলেও র্বতমানে সেগুলো আবারও প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাবান ও পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে বলা হয়েছে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনায়। এছাড়া মাংস ও ডিম অবশ্যই যথাযথ তাপে ও ভালোমত রান্না করে খেতে বলা হয়েছে। হাঁচি ও কাশির সময় অবশ্যই হাত বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে হবে। এরপর টিস্যু ফেলে দিতে হবে এবং অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে। যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার পর হাত ধুতে হবে। কোনো প্রাণির যতœ নিলে বা স্পর্শ করলে ও প্রাণিবর্জ্য ধরার পরও হাতে ধুতে হবে। শরীরে যে কোনো সংক্রমণ এড়াতে রান্না ও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। নিজের পাশাপাশি অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়েছে ডব্লিউএইচও। ব্যবহার করা টিস্যু খোলা ঝুড়ি বা ডাস্টবিনে না ফেলে ঢাকনা রয়েছে এমন ঝুড়িতে ফেলতে হবে। হাতে গ্লাভস না পরে বা নিজে সুরক্ষিত না থেকে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির মুখ ও দেহ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একইভাবে গবাদিপশু ও বন্যপশুকে ধরার আগেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। রান্নাঘরের কাজেও বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলছে । কাঁচা মাংস, সবজি, রান্না করা খাবার কাটার জন্য ভিন্ন চপিং বোর্ড ও ছুরি ব্যবহার করতে হবে। কাঁচা মাংস, সবজি ও রান্না করা খাবার হাতে ধরার আগে অবশ্যই প্রত্যেকবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। রোগে ভুগে মারা যাওয়া বা অসুস্থ প্রাণীর মাংস একেবারেই খাওয়া চলবে না। তবে রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকাতেও উপযুক্ত তাপে ও ভালোভাবে সিদ্ধ করা মাংস খেলে ঝুঁকি নেই। কাঁচা বাজারে গিয়ে কোনো প্রাণী ও প্রাণীর মাংস হাতে ধরলে দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। কাঁচা বাজারে অবস্থানের সময় অযথা মুখে-চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাজের জায়গাটি দিনে অন্তত একবার হলেও পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পরিধেয়টি অবশ্যই প্রতিদিন বদল করতে হবে এবং ধুতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা ভালো। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কের মধ্যে ভ্রমণ বিষয়েও সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদি জ্বর-সর্দি অনুভূত হয়, তাহলে যে কোনো ভ্রমণ বাতিল করাই ভালো। পাশাপাশি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও ওষুধ খেতে হবে। জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এমন কারো সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি মাস্ক ব্যবহার করা হয়, তবে নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। একবার মাস্ক পরলে তা বার বার স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একবার মাস্ক ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হবে। মাস্ক ধরার পর হাতে ধুয়ে নিতে হবে। যদি ভ্রমণের সময় অসুস্থ বোধ হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। এর আগে রোগের ইতিহাস থাকলে সেটাও চিকিৎসককে জানাতে হবে। যেখানে সেখানে বা জনসমাগমের স্থানে থুথু ফেলা যাবে না। অসুস্থ প্রাণী ধরা থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
করোনা থেকে নিরাপদ থাকতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শগুলো কাজে লাগানোর কারণেই শীতকালে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি হয় নি। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ সেগুলোকে না মানার কারণ হতে পারে। বাঁচতে হলে, পরিবার-পরিজনদের বাচাতে হলে উপরোক্ত নিয়মের সাথে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া ১৮ নির্দেশন আমাদের মানতে হবে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার টিকা পায় ন্ইা সেখানে আমরা সফল হয়েছি। টিকা দিয়েছে দেশের লক্ষ মানুষ। সুতরাং এই ঢেউতেও আমাদের সফল হতে হবে।
যেকোন রোগ-ব্যাধিতে আমার কাছে সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাসটাই বড় বলে মনে হয়। আমার মনে হয় মহাঅসুখেও যদি সাহস ও মনোবল থাকে তাহলে সেই অসুখটা ৫০% নির্মূল হয়। আর মনোবল দুর্বল হলে সেই অসুখটা ৫০% বেড়ে যায়। ঠিক একই ভাবে কঠিন অসুখে চিকিৎসক যদি ভাল ব্যবহার করে রোগীকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে তাহলে ৫০% রোগ তখনই ভাল হয়ে যায় বলে মনে হয়। আমার কাছে করোনা ভাইরাসের সর্তকতাগুলো কিন্তু শুধু এই ভাইরাসের কারণেই না যে কোন রোগ থেকে বাঁচার জন্যই করা দরকার। সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শুধু করোনা ভাইরাস না সকল ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা যাবে। তাই আসুন আমরা সচেতন থাকি আর অন্যদের সচেতন করি। কারণ সচেতনতায় করোনা জয়ের প্রধান ভ্যাকসিন। করোনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরি করি। নিরাপদ জীবন গড়ি। চলছে পবিত্র রমযান মাস। পবিত্র এই মাসে আর কোন স্বজন যেন বিদায় না নেয় সেদিতে খেয়াল রাখি। পরিবার-পরিজন নিয়ে আগামীতে আনন্দঘন পরিবেশে পবিত্র ঈদ-উল ফিতর পালনের জন্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট