কারখানায় কাজ করছে পাদুকা শ্রমিকরাপ্রায় ৩০ বছর ধরে পাদুকা কারখানায় কাজ করছেন মো. রফিক। এ কাজ করেই ছয় সদস্যের পরিবার চলে তার। প্রতি বছর রমজান মাসে বাড়তি কাজ করে বেতনের বাইরে যে টাকা পান, তা দিয়েই পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা করেন। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এবার হাতে খুব একটা কাজ নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের পীরবাড়ি এলাকার এক্টিভ পিউ ফুটওয়্যারের ফিটিংম্যান রফিকের। একই অবস্থা অন্যান্য কারখানার শ্রমিকদেরও।
ভরা মৌসুমেও সংকটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্ভাবনাময় পাদুকা শিল্প। করোনার সংক্রমণের বিস্তার রোধে চলমান লকডাউনের কারণে গত বছরের মতো এবারও লোকসানের শঙ্কা করছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা। অনেক কারখানায় উৎপাদিত কয়েক কোটি টাকার জুতা পড়ে আছে। লকডাউনের কারণে সেগুলো বাজারজাত করা যাচ্ছে না।
এ ছাড়া লকডাউনের কারণে জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে করোনাঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাদুকা শিল্প। সরকারি নির্দেশনায় লাকডাউনের মধ্যে কারখানা খোলা রেখে এখন লোকসান গুণতে হচ্ছে মালিকদের। সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিপণিবিতানগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের পাটনার ব্যবসায়ী মাহমুদ আলী ১৯৬৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি পাদুকা কারখানা করেন। তার হাত ধরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ শিল্পের বিস্তার ঘটে। বর্তমানে জেলায় ছোট-বড় মিলে দেড়শ পাদুকা কারখানা চালু রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি কারখানায় মেশিনের সাহায্যে জুতা তৈরি হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারখানাগুলোতে ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামের জুতা তৈরি হয়। প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক পাদুকা কারখানাগুলোতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে ভরা মৌসুমেও মাথায় হাত পড়েছে পাদুকা ব্যবসায়ীদের। চলমান লকডাউনের কারণে জুতা নেওয়ার জন্য পাইকারা আসতে পারছেন না কারখানাগুলোতে। ফলে কয়েক কোটি টাকার জুতা কারখানাগুলোতে পড়ে আছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রোজার মাসকে পাদুকা ব্যবসার মৌসুম ধরা হয়। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত বছর মার্চ মাসের শেষ দিকে সরকারি নির্দেশনায় পাদুকা কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওই বছরের জুনে কারখানাগুলো খোলা হয়। তবে শ্রমিকরা কাজে না আসায় এবং বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে জুতার উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। এর ফলে গত বছরের মৌসুম ধরতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এরপর শীত মৌসুমেও অলস সময় পার করেছেন পাদুকা কারখানার শ্রমিকরা।
কিন্তু এই দুর্দিনেও কারখানার ভাড়া ও স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ সকল ব্যয়ই মেটাতে হয়েছে মালিকদের। এতে করে গেল বছর পাদুকা শিল্পে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটি টাকা। সুদিনের আশায় থাকা পাদুকা শিল্পে নতুন করে সংকট দেখা দেয় চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার বেড়ে যাওয়ায় সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে নতুন করে সংকটে পড়েন ব্যবসায়ীরা। অথচ প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় বড় কারখানাগুলো গড়ে ১ থেকে দেড় কোটি টাকা মূল্যের জুতা বিক্রি করে থাকে। আর ছোট কারখানাগুলো বিক্রি করে ২০-২৫ লাখ টাকার জুতা। কিন্তু গেল বছর করোনাভাইরাসের কারণে দুই ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি।
এবারের ঈদ মৌসুমে ব্যবসা করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করলেও, সেটি আর হচ্ছে না। এ ছাড়া জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দামও বেড়েছে। ১৭০ টাকা লিটারের কেমিক্যাল এখন কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকায়। আর লকডাউনের আগে এক গজ ফোমের দাম ছিল ৩৮০-৩৯০ টাকা। সেই ফোম এখন সাড়ে ৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য কাঁচামালের দামও বেড়েছে। রোজার মাসে কাজের চাপে যে শ্রমিকদের দম ফেলার ফুরসত মিলত না, সেই শ্রমিকরাও কাজের আশায় অনেকটা অলস সময় পার করছেন।
এক্টিভ পিউ ফুটওয়্যারের ফিটিংম্যান মো. রফিক জানান, আগে রোজার মাস এলে সারারাত কাজ করতেন। কিন্তু গত বছর থেকে কারখানায় আগের মতো কাজ নেই। এর ফলে রোজার সময় বাড়তি কাজ করে যে টাকাগুলো পেতেন, সেগুলো এবারও পাবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
লকডাউনের কারণে কাজ কমে গেছে। উৎপাদিত জুতা বাজারজাত করা যাচ্ছে না, সেজন্য মালিক কারখানা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে লোকসান দিয়ে এখনো কারখানা সচল রেখেছেন। কাজ কমে যাওয়ায় আয়-রোজগারও কমে গেছে বলে জানান তিনি।
এক্টিভ পিউ ফুটওয়্যারের স্বত্বাধিকারী মো. রাকিবুর রহমান বলেন, গত বছর আমার প্রায় ৩০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ভেবেছিলাম এবারের ঈদ মৌসুমে সেই লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু এখন আরও লোকসানে পড়তে হচ্ছে। লকডাউনের কারণে কাঁচামালের দাম বেড়েছে।
দোকানপাট বন্ধ থাকায় আমার কারখানায় উৎপাদিত প্রায় দেড় কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করতে পারছি না। এর ফলে জুতার উৎপাদন কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।
সেভেন স্টার ফুটওয়্যারের পরিচালক মো. হানিফ জানান, সরকার লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ রেখেছে, অথচ আমাদের কারখানা খোলা রাখতে বলেছে। কিন্তু দোকানপাট বন্ধ থাকায় কারখানা খোলা রেখে আমাদের আরও লোকসান হচ্ছে। সেজন্য আমাদের দাবি স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি কাজী শফিউদ্দিন বলেন, এমনিতেই বিদেশি জুতার কারণে আমাদের দেশীয় জুতার চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় করোনার কারণে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে এবং লকডাউন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে গত বছরের মতো এবারও লোকসানে পড়তে হবে। সেজন্য সরকারের উচিত দেশীয় এই শিল্পের দিকে সুদৃষ্টি দেওয়া।