করোনাকালীন সময়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কি অবস্থা, শিক্ষার্থীদের কি পরিমান ক্ষতি হচ্ছে, স্কুল কলেজ মাদ্রসা বন্ধ রয়েছে গত বছর ১৭ মার্চে থেকে কিন্তু দেদারসে চলছে শিক্ষকদের প্রাইভেট, কোচিং বানিজ্য, রহস্যজনক কারণে প্রশাসন রয়েছে নিরব দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু কোনা কোন স্থানে এসব অবৈধ প্রাইভেট কোচিং বানিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন প্রশাসন যা পত্র পত্রিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের কতটা উপকারে এসেছে। স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেটের গতি নিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা কতটা সমস্যার মুখে পড়েছে। এ সম্পর্কে লিখার জন্য, তথ্য উপাত্ত নিয়ে ল্যাপটপ ওপেন করলাম। এমন সময় মহিশালবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া আমার ছোট ছেলে আজিজ আরিফিন জিম বলে আব্বু আবদুল হামিদ খান ভাসানী কে তিনি কী করেছিলেন দেশের জন্য আমি বললাম একটু ব্যস্ত আছি তোমাকে পরে বিস্তারিত বলচ্ছি তখন সে একটু রাগ করে বললো তোমার স্মার্ট ফোন দাও ফোন নিয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে ওঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বের করলো তাই লিখার থিম পরিবর্তন করে আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে আল্লাহর নাম নিয়ে লিখা শুরু করলাম।
২০০৪ ইং সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় নবম স্থানে আসেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী।। আর ১ নং হন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ছয় দশক ধরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন মওলানা
আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে।
তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বহু ঘটনার কেন্দ্রেই ছিলেন মওলানা ভাসানী, যাকে তাঁর ভক্তরা "মজলুম জননেতা" বলে সম্বোধন করতেন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান (১৮৮০-১৯৭৬) রাজনীতিক। মওলানা ভাসানী নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন স্ব-শিক্ষিত ব্যক্তি। তাঁর জীবন ছিল গ্রাম ভিত্তিক, মতবাদ উগ্র এবং ঔপনিবেশিক রীতিনীতির প্রতি আস্থাহীন। সারা রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রচুর প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন এবং বেশ কিছু সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন; তবে কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেন নি। তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তি ছিল কৃষক শ্রমিক জনসাধারণ, যাদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে গেছেন।
তিনি ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন হাজী শরাফত আলী খান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় কয়েক বছর অধ্যয়ন ছাড়া তাঁর বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকার কালা গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। পরে তিনি টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে গিয়ে তথাকার অত্যাচারিত কৃষকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ত্রিশের দশকের শেষদিকে তিনি আসামের ঘাগমারায় বসবাসকারী বাঙালিদের স্বার্থরক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ঐ এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাসানচরে বন্যার কবল থেকে বাঙালি কৃষকদের রক্ষার জন্য তিনি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। ভাসানচরের জনসাধারণ তাকে ‘ভাসানী সাহেব’ বলে অভিহিত করে এবং পরবর্তীকালে এ উপাধি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
আসাম সরকার আইন করে এমন একটি ভৌগোলিক সীমারেখা টেনে দেয় যে বাঙালিরা ঐ সীমা অতিক্রম করে বসতি স্থাপন করতে পারত না
এ আইনের বলে স্থানীয় অহমীয়রা ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অচিরেই দলের আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদউল্লাহ্র সঙ্গে মওলানা ভাসানীর সংঘর্ষ বাঁধে। ভারত বিভাগের সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আসাম সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এ শর্তে মুক্তি দেয় যে, তিনি আসাম ছেড়ে চলে যাবেন।
১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলায় আসেন, কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব থেকে তাঁকে দূরে রাখা হয়। তিনি দক্ষিণ টাঙ্গাইল এলাকার উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নর অসদুপায়ের অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন এবং সকল প্রার্থীকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪৯ সালে পন্নীর ওপর থেকে এ বাধা তুলে নেওয়া হয়, কিন্তু ভাসানীর ওপর তা বলবৎ থাকে।
১৯৪৯ সালে ভাসানী পুনরায় আসাম যান, এবং সেখানে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ধুবড়ি জেলে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর মুক্তি পেয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতৃত্বে সংকট দেখা দেয় এবং দলের যুব-সদস্য ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের ক্ষুব্ধ সদস্যরা ঢাকায় ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন এক কর্মী সম্মেলন আহবান করে। এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় স্বামীবাগের রোজ গার্ডেনে। এতে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ প্রতিনিধি যোগদান করেন। ২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল জন্মলাভ করে। এর সভাপতি হন মওলানা ভাসানী, এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। জন্মদিনে নতুন দলটি ঢাকার আরমানিটোলায় ভাসানীর সভাপতিত্বে একটি জনসভার আয়োজন করে। ঐ স্থানে দ্বিতীয় সভাটি করা হয় ১১ অক্টোবর, এবং সভা শেষে প্রদেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রতিবাদে একটি শোভাযাত্রা নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে অগ্রসর হলে ভাসানীসহ নতুন দলের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে অনশনের ফলে তাঁর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় (১৯৫০)।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। ভাসানী এর কড়া প্রতিবাদ করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। রাজনৈতিকভাবে ভাসানী এতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে ভাসানী সবচেয়ে প্রতিবাদী এবং শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ভাসানী তখনকার পাঁচটি বিরোধী দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি মোর্চা গঠন করেন। এ মোর্চার অপরাপর নেতা ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন।
বারবার কারাবরণের ফলে কারাগারে কমিউনিস্টদের সঙ্গে মওলানার যোগাযোগ ঘটে এবং তিনি সমাজতান্ত্রিক মতবাদ সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠেন। কমিউনিস্টরা তাঁকে আদমজী জুটমিল মজদুর ইউনিয়নের এবং পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের সভাপতি করে। ১৯৫৪ সালের মে দিবসে তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি বৃহৎ শ্রমিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। ঐ বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি হন। এর কিছুদিন পর তিনি কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্তর্জাতিক শান্তি কমিটির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি পদে আসীন হন এবং স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সুযোগে তিনি ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেন।
ইতোমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভাঙনের সম্মুখীন হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিনি এ দ্বন্দ্ব মেটাতে পারেন নি। এদিকে ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন এবং আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানার মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মওলানা তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। মওলানা তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলন আহবান করেন। ঐ সম্মেলনে তিনি সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। এ মতবিরোধের কারণে দলে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ বছর মওলানা ভাসানী ঢাকায় পাকিস্তানের সকল বামপন্থি দলের একটি সম্মেলন আহবান করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। তিনি এ দলের সভাপতি হন এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। এ সময় থেকে মওলানা প্রকাশ্যে বামপন্থি রাজনীতি অনুসরণ করতে থাকেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে মওলানাকে আবার আটক করা হয়। ১৯৬৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা চীন ভ্রমণে যান এবং ১৯৬৪ সালে হাভানায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমন্ডলীর কঠোর বিরোধিতা করেন এবং প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব সমাজতন্ত্র সোভিয়েতপন্থি ও চীনপন্থি এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপও ভাগ হয়, এবং মওলানা চীনপন্থি দলের নেতৃত্বে থাকেন।
তিনি আইয়ুব সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় হিসেবে গণ্য করেন এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁকে মুক্তি দানের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। বিরোধীদলের কঠোর আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসীন হন।
রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। মওলানা নির্বাচন বয়কট করে নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে আত্মনিয়োগ করেন। ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার কারণে মওলানা প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে তিনি সর্বপ্রথম যে দাবিটি তোলেন তা হলো বাংলাদেশ ভূখন্ড থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ। ঐ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি হক কথা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। অচিরেই পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পত্রিকাটি অল্পদিন পরেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মওলানা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙখলা পরিস্থিতির অবনতি এবং খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি হুকুমত-ই-রববানী তরিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারত-সোভিয়েতের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ছয়টি দল নিয়ে মওলানার নেতৃত্বে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এ ফ্রন্ট ভারত-বাংলাদেশ সীমানা চুক্তি অবিলম্বে রদ এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানায়। ৩০ জুন মওলানাকে গ্রেপ্তার করে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে স্বীয় বাসভবনে গৃহবন্দী করা হয়। মওলানা ভাসানী ফারাক্কা চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থি বলে মনে করেন। তিনি
১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখে এক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারত বিরোধী নানা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। দুপুর দুইটায় হাজার হাজার মানুষের স্রােত জেলার গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ছয়টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাতযাপনের জন্য সে দিনের মতো শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করার পরদিন সোমবার সকাল আটটায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে।
ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় এই লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হয়। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।
তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’
মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। ১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তিনি খোদায়ী খিদমতগার নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সন্তোষে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি সন্তোষে একটি কারিগরি শিক্ষা কলেজ, মেয়েদের একটি স্কুল এবং একটি শিশু কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি পাঁচবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ এবং কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আসামে তিনি ইতোপূর্বে ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। আমরা তার জন্য গর্বিত।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক