দেশজুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে চলছে কঠোর লকডাউন। কিন্তু তার মধ্যেও দেশের অন্যতম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। নিয়মিতভাবেই ভোগ্যপণ্য, মেগা প্রকল্পের পণ্য, সিমেন্টের ক্লিংকার, ইস্পাত খাতের স্ক্র্যাপবাহী জাহাজসহ বিভিন্ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পণ্য খালাস হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের মতে, কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, ব্যাংকসহ আমদানি-রফতানি ও ডেলিভারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নির্বিঘœ সেবা পেলে দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর ২৪ ঘণ্টাই চালু রাখা যাবে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ প্রতিরোধে ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকরে ১৩ নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তাতে বলা হয়েছে, সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ও সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। তবে বিমান, সমুদ্র ও স্থলবন্দর এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিস নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে গত বছর লকডাউনের মাঝে শত শত টন পণ্য বন্দরের ইয়ার্ডে এসে জমা হলেও শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যথাসময়ে তা ডেলিভারি হয়নি। একটা সময় অনেক দেশই জাহাজ বন্ধ রেখেছিল। তাছাড়া ক্রয়াদেশ না থাকায় তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানিও বন্ধ থাকে। আর করোনা সংক্রমিত হয়ে ১৫ কর্মী মারা যাওয়ায় বন্দরের কাজে আরো বিঘœ ঘটে। তবে এ বছরও এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ বন্দরে শ্রমিকদের নিরাপত্তায় আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই এবার শ্রমিক সঙ্কট নেই।
সূত্র জানায়, করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের মাঝেও ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে আমদানি-রফতানি উভয়ই বেড়েছে। আমদানি-রফতানির গতি বাড়তে থাকাকে ব্যবসায়ীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনকারী শিপিং লাইনগুলোর তথ্যানুযায়ী, মার্চে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেনার এসেছে ১ লাখ ১৭ হাজার টিইইউ (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) বা একক, আর রফতানি পণ্যভর্তি কনটেনার ছিল ৬০ হাজার ১৫২ একক। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেনার এসেছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৭০০ একক আর রফতানি ছিল ৫৭ হাজার ৮৫৪ একক। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, ধারণা করা হচ্ছিল কঠোর বিধিনিষেধে বন্দরে পণ্য খালাসের গতি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা গতবারের মতো হয়নি। এবার দ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্য ওঠানামা সচল রাখতে তিনটি বিভাগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বন্দরের পরিবহন বিভাগ। ওই বিভাগের অন্তত ১২শ’ কর্মী কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই বন্দর সচল রাখতে কাজ করছে। কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর পর পরিবহন বিভাগের অনেক কর্মীই আতঙ্কে কাজে যোগ দিতে অনীহা দেখাচ্ছিল। তবে শীর্ষ কর্মকর্তারা জেটিতে-শেডে দাঁড়িয়ে থেকে কর্মীদের কাজে গতি আনতে কাজ করছে। যেজন্য অন্য কর্মীরা এখন নিয়মিত কাজ করছে। বন্দরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো মেরিন বিভাগ। ওই বিভাগের কর্মীরা বহির্নোঙরে আসা বিদেশী জাহাজে উঠে বিদেশী নাবিকদের নিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে চালিয়ে আবার জেটিতে আনে। একইভাবে আবার পণ্য ছাড় শেষে জাহাজটি চালিয়ে নিয়ে যায় তারা। ঝুঁকি আছে জেনেও তারা প্রতিদিন এ কাজ করছে। জাহাজ থেকে পণ্য নামানোর পর সেটি বন্দর থেকে দ্রুত ছাড় দেয়া নির্ভর করে বন্দর গেটে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর। তাছাড়া বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশপথে কর্মীদের করোনা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও একই সঙ্গে চোরাচালান ঠেকাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ। চট্টগ্রাম বন্দরে সব মিলিয়ে সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। প্রত্যেকেই এই বিধিনিষেধের মধ্যে কাজ করছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন জানান, বন্দর ও কাস্টমসের কাজকর্ম এখনো পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক হয়নি। ডকুমেন্টেশনসহ বেশিরভাগ কাজই সশরীরে গিয়ে করতে হয়। ওসব কাজে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন, তারা যেন যাতায়াতে বাধার মুখে না পড়ে তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে বন্দর থেকে তাদের জন্য সাময়িক কোন পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে পণ্য জাহাজে তোলা, খালাস ও ডেলিভারি ব্যাহত হতে পারে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে শুধু দাফতরিক কাজের জন্য শিফট করে কাজ চলছে। আর বন্দরের অপারেশনের কর্মীরা নিয়মিত কাজ করছে। তাই স্বাভাবিক সময়ের মতোই চট্টগ্রাম বন্দর সচল রয়েছে। গতবারের মতো এবার কোন সমস্যা হবে না। মেগা প্রকল্পের পণ্যগুলো দ্রুত ছাড় দেয়া হচ্ছে।