ক্রমবর্ধমান হারে করণা প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় এখন ২য় দফার লকডাউন শুরু হয়েছে। ২১আগস্ট থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত চলবে এই লকডাউন। এর আগে ১৪আগস্ট থেকে শুরু হওয়া লকডাউন জনগণকে ঘরে বন্দি করে রাখতে পারেনি। রাজপথে জনজট ও যানজট নাকাল হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর মহানগরীর অলিগলি তো ছিল পথচারীদের হাঁটার আড্ডার অভয় আশ্রম। যদিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুভমেন্ট পাস ও যৌক্তিক কারণ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে, আদায় করেছে জরিমানা। কিন্তু জনসচেতনতা বাড়েনি। করোনা পরীক্ষার প্রতিও জনগণের আগ্রহ কমেছে। অনেকেই আগে যেমন নানা ঝক্কি ঝামেলা পোহাবার পরও নির্দিষ্ট বুথে গিয়ে স্যাম্পল দিয়েছেন পরীক্ষার জন্য তা এখন দেখা যাচ্ছে না। ১ম দফা করোনা আক্রমণে মানুষের মাঝে যে ভয় বা আতঙ্ক ছিল এখন তার নেই। সবাই কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
ভারত থেকে চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো করোনা টিকা আসছে না বলে খবর বেরিয়েছে সংবাদমাধ্যমে। জোর কূটনৈতিক তৎপরতার পরও ভারত থেকে টিকা পাওয়ার বিষয়টি সুরাহা হচ্ছে না।ফলে এর মধ্যে যারা ১ম ডোজ টিকা নিয়েছেন সময়মতো তাদের ২য় ডোজ টিকা পাওয়াটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। গত ২০ এপ্রিল পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন ৭১ লাখ ৬৮ হাজার ৮০৯ জন। ১ম ডোজ টিকা পেয়েছেন ৫৭ লাখ ৬১ হাজার ৯০২ জন। ২য় ডোজ টিকা পেয়েছেন ১৮ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৭ জন।২১ এপ্রিল পর্যন্ত টিকা মজুদ ছিল প্রায় ২৭ লাখ। এখন প্রতিদিন দেড় থেকে দু লাখ টিকা দেওয়া হচ্ছে। কাজেই সংক্রমণ ঠেকাতে যে টিকার ওপর সবাই নির্ভর করছেন তাও পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত এর টিকা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। তাদের মোট ৩ কোটি টিকা দেওয়ার কথা। সে অনুসারে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসেছে সারা ৭০ লাখ টিকা। প্রতিমাসে ৫০ লাখ টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত আর কোন টিকার চালান বাংলাদেশে আসেনি। সরকার টিকা সংগ্রহ এর বিকল্প পথেরও অনুসন্ধান করেনি। টিকা নেওয়ার পর করোনা আক্রান্ত মানুষের খবর প্রায়ই শোনা যাচ্ছে । ২য় ডোজ টিকা নেবার পর তাদের করোনা থেকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এমন পরিস্থিতির মাঝে লকডাউন এর মাঝেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রেখে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দেশের সামর্থ্যবান মানুষেরাই লকডাউন উপেক্ষা করছেন নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি পথে বের করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বাহিনীর জরিমানার টাকাও তারা গুনছেন। আর নিরীহ রিক্সা চালক তার পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য রিকশা নিয়ে পথে বের হলে তার রিক্সাটি রাস্তায় উল্টিয়ে রাখা হচ্ছে। নিরীহ রিকশাচালকেরা আহাজারি কারো অন্তরের সহানুভূতি সৃষ্টি করছে না। ১ম দফায় করোনা সংক্রমনের সময় লকডাউন ঘোষণার পর প্রথম কয়েকদিন পুলিশকে দেখা গিয়েছিল খুব ক্ষুব্দ।রিকশাওয়ালাদের রিকশা উল্টে রেখে তাদের কান ধরে উঠবস করিয়েছে। কিন্তু তারপরই হঠাৎ করে পুলিশ খুব মানবিক হয়ে ওঠে। তারা দরিদ্র দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তারা তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়, সহযোগিতা হাত প্রশস্ত করে। কিন্তু এখন আর সেই মানবিক পুলিশ আমরা দেখতে পাচ্ছি না বরং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে গেছে। লকডাউন এর বাইরে থাকা ব্যক্তিদের সাথে তারা ওষুধ জন্য আচরণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউন কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসার পথে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোষ্টে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, জরিমানা ও দিয়েছেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসকের সঙ্গে আইডি আইডি নিয়ে তুমুল বাক-বিত-া হয় পুলিশও কর্মরত এক ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে। সে সময়ে ধারণ করা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশ ও ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চিকিৎসক অ্যাসোসিয়েশন পাল্টা-পাল্টি বিবৃতি দেয়। এমনকি বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট বলেছেন পাল্টাপাল্টি বিবৃতি অনভিপ্রেত।
আমরা জানি পুলিশ এবং চিকিৎসা উভয়ই করোনাকালে সম্মুখ যুদ্ধা। তারা করোনা নিয়ন্ত্রণে নিরলস কাজ করছে। সারা বিশ্বে করা যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসকরা বিশেষ সম্মান পাচ্ছেন। বাংলাদেশেও তাদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে কাজেই পুলিশ এবং চিকিৎসক উভয়ের সহিষ্ণু আচরণ করা উচিত। কে কত ক্ষমতাবান তা প্রদর্শন না করে কে কতটা সহযোগী হয়ে উঠতে পারেন সে চেষ্টায় সবাইকে মহিমান্বিত করবে। আমরা আশা করবো আগামীতে আর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
করোনার প্রকোপে পড়ে কখন কি হয় কেউ জানে না। কে বাঁচে কে মরে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তারপরও সরকার দলীয় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঈদের আগে লকডাউন তুলে নেয়া হবে। অবশ্যই কথা ঠিক দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে মার্কেটের শপিংমলগুলো খুলে দেওয়ার চাপ রয়েছে। তারা বলছেন, গত ঈদে তারা ব্যবসা করতে পারেননি, এবারও যদি সম্ভব না হয় তবে তাদের রাস্তায় বসতে হবে। ব্যাংক ঋণের ঝামেলায় তারা দিশেহারা। প্রশ্ন হচ্ছে লকডাউন তুলে ফেলার পর ঈদ বাজার করার জন্য জনগণ বাঁধভাঙ্গা ¯্রােতের মত যেভাবে বাজারে শপিংমলে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন তা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? বাজার শপিং মলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানা সম্ভব নয় তা বারবার প্রমাণ হয়েছে। সর্বাত্মক লকডাউনের নামে যে ঢিলেঢালা লকডাউন চলছে তা থেকে কতটা প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে তা নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাঝে সন্দেহ রয়েছে। তারপরও যদি লকডাউন তুলে নেওয়া হয় তবে সংক্রমণ যে হারে বাড়বে তাতে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।