কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এ ফলগাছটি দিনদিন বিলিন হয়ে যাচ্ছে মণিরামপুরের প্রত্যন্ত গ্রামঅঞ্চল থেকে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় পানি অসহনীয় ফলগাছটি দিনদিন হারিয়ে যাবার পথে। ফলে আবহাওয়ার প্রাকৃতিক ভারসাম্য যেমন হুমকির মুখে, তেমনি মানুষের শরীর থেকে পুষ্টিগুণ ঝরে পড়ছে।
বাংলা নামধারি জাতীয় ফল কাঁঠালের ইংরেজি নাম হলো ঔধপশভৎঁরঃ। যার বৈজ্ঞানিক নাম অৎঃড়পধৎঢ়ঁং। ফলটি মোরাসিয়া পরিবারের (ডুমুর বা পাউরুটি পরিবারের প্রজাতি) এবং অর্টোকার্পাস গোত্রের ফল। এর মূল উৎস দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ঘাট এবং মালয়েশিয়ার রেইন ফরেস্টের মধ্যবর্তী অঞ্চলে।
জানাযায়, কাঁঠাল সকল ফল সমূহের মধ্যে বৃহত্তম আকারের। বাংলাদেশের সর্বত্রই কাঁঠাল পরিদৃষ্ট হয় এবং এর পুষ্টিগুণ সবচেয়ে বেশি। দেশের আনাচে-কানাচে কাঁঠালের সহজলভ্যতা বা প্রাপ্তিই রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামের শ্রমজীবী আপামর জনসাধারণের কাছে কাঁঠালের গুরত্ব অপরিসীম বলে এটা জাতীয় ফল হিসেবে পরিচিত। কাঁঠালের দাম অন্যান্য ফলের তুলনায় কম হওয়াতে গরিব মানুষও এটা খেতে পারে। তাই কাঁঠালকে গরিবের ফল বলা হয়। সাধারণত লালচে মাটি ও উঁচু এলাকায় এ ফলগাছটি বেশি দেখা যায়। তবে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং পার্বত্য এলাকায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। উদ্যানতত্ত্ব অনুবিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকা সূত্রমতে বাংলাদেশে ৭৬ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল চাষ হচ্ছে। কাঁঠাল চাষে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
উপজেলার নেহালপুর গ্রামের শিক্ষাবিদ সন্তোষ রায় বলেন, কাঁঠাল একটি চৌকস ফল। এর কোয়াগুলো মানুষের খুবই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। বীজ অর্থাৎ আটিগুলো ভাজি অথবা তরকারি রান্না করে খেতে বেজায় মজাদার। আবার বীজ থেকে পুনরায় চারা তৈরি হয়। গায়ের কাটাকাটা অংশগুলো যার আরেক নাম ছোবড়াগগুলো গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া গাছের পাতগুলোও অনুরুপভাবে গবাদি পশুকে খাওয়ানো হয়। গাছের ছোট-বড় ডালগুলো পরিবারের জ¦ালানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রয় করলে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বি হওয়া সম্ভব। এ ছাড়া সর্বোপরি বড় কাঠ অর্থাৎ লগ দিয়ে গুণগতমানের মসৃণ ফার্নিচার তৈরি যায় অথবা কাঠ বিক্রি করলে পারিবারিক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা মিটানো যায়। অনেক সময় ফলবৃক্ষ গাছ পরিবারের ইনসুরেন্স (বীমা) হিসেবে কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, ভবদহ গ্রাসের কারণে বর্তমান সময়ে আমাদের অঞ্চল পানিতে প্লাবিত থাকায় কাঁঠাল গাছের গোড়ায় পানি জমে গাছগুলো মরে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে লালিত গাছগুলো একরে পর এক ধ্বংস হতে চলেছে। ফলে পরিবারের খাওয়ার চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছেনা। অপরদিকে ফল এবং গাছ থেকে অর্থনৈতিক অভাবতো আছেই।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানাগেছে, উপজেলার মশ্মিমনগর, কাশিমনগর, চালুয়াহাটী, শ্যামকুড় আংশিক, মণিরামপুর সদর, রোহিতা ইউনিয়ন উঁচু ভূমির এলাকা হওয়ায় এসব অঞ্চলে অধিক পরিমাণে কাঁঠাল গাছ রয়েছে এবং প্রচুর ফল ধরছে গাছে। তবে, উপজেলার পূর্বাঞ্চলের খানপুর, দূর্বাডাঙ্গা, কুলটিয়া, নেহালপুর এবং মনোহরপুর ইউনিয়নের কিছু কিছু উঁচু স্থান বাদে অধিকাংশ জায়গায় কাঁঠালগাছ মরে সাবাড় হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন বলেন, কাঁঠাল পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল। এতে আছে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান। এ ছাড়া কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় মানব দেহের জন্য বিশেষ উপকারী। কাঁঠালে চর্বির পরিমাণ নিতান্তই কম।
তিনি আরও বলেন, এ ফল খাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা খুবই কম। কাঁঠাল পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। পাকা কাঁঠালে প্রচুর ভিটামিন এ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হলো ভিটামিন সি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে ভিটামিন সি। কাঁঠালের বিদ্যমান আইসোফ্লাভোনস, এন্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস আলসার, ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। এ ফল আঁশালো বিধায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসান বলেন, বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩ নামে তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত রয়েছে। সর্বশেষ জাতটিতে অমৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। হাজারী কাঁঠাল নামে অতি জনপ্রিয় একটি জাত রয়েছে, এ গাছটিতে ছোট ছোট অনেক ফল ধরে থাকে। বাংলাদেশে চাষকৃত জাতগুলো তিন ভাগে বিভক্ত। যথা- খাজা বা চাউলা কাঁঠাল। যার কোষ আকারে বড় হয় এবং পাকার পর কম রসালো থাকে। গিলা বা রসা কাঁঠাল। এর কোষগুলো অত্যন্ত কোমল ও মিষ্টি হয়। সর্বশেষ দোরসা কাঁঠাল। এর বৈশিষ্ট্য খাজা ও গিলা কাঁঠালের মাঝামাঝি। স্থান ও জাতভেদে কাঁঠাল পাকে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
তিনি আরও বলেন, উঁচু ভূমি কাঁঠাল চাষের জন্য সর্বোত্তম। কাঁঠাল গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে কোনক্রমেই গাছ বাঁচানো সম্ভব হয়না। ফলে মণিরামপুরের কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের কোন জুরি নেই। তবে মণিরামপুরসহ দেশের সর্বত্রই এখনও কাঁঠালের যথেষ্ঠ কদর রয়েছে।