কোন ডাক্তার নেই। নার্স নেই। নেই হসপিটালের অনুমোদন। অথচ প্রতিদিন গ্রামের মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। করা হচ্ছে সব ধরনের অপারেশন। কোন ডাক্তার অপারেশন করছেন, তাও কেউ জানেন না। এমনই এক নাম সর্বস্ব চিকিৎসা কেন্দ্র গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ডিজিটাল হসপিটালে নরমাল ডেলিভারিতে মাথা ছিড়ে ফেলার পর এবার হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা সিজারিয়ান অপারেশন করতে প্রসাবের দ্বার কেটে নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে এলাকায় চলছে তোলপাড়। প্রতিবাদ করায় স্বজনদের হাসপাতাল থেকে বের করে গেটে তালা ঝুলিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের হাসপাতালে প্রবেশেও বাঁধা দেয়া হয়েছে।
কোন কিছু না জেনে কিংবা না বুঝেই এদের ফাঁদে পা দিয়ে একের পর এক প্রসুতি মা ও নবজাতকের মৃত্যু সহ সর্বস্ব হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণের ঘটনা ঘটছে চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে। বার বার ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে আসলেও স্থানীয় প্রশাসন শুধু পরিদর্শন করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। এ ঘটনায় এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ভুক্তোভোগীর স্বজনদের অভিযোগ, মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে সাঘাটার বোনারপাড়া রেলওয়ে কলোনি এলাকা থেকে প্রসূতি মোমিনাকে নেয়া হয় বোনারপাড়া ডিজিটাল হসপিটালে। দুপুরেই সিজারিয়ান অপারেশন হয়। এক কন্যাসন্তান জন্ম দেন তিনি। জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর কার্টুনবন্দি শিশুর মরদেহ প্রসূতি মোমিনার স্বজনদের হাতে তুলে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাড়িতে এসে নবজাতকের প্রসাবের দ্বারসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান কাটা দেখতে পান স্বজনরা। পরে তারা হাসপাতালে যোগাযোগ করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তাদের।
বিষয়টি জানাজানি হলে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় বোনারপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ ও ইউএনও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। তবে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে হাসপাতালটি থেকে বেরিয়ে যান তারা। নবজাতকের বাবা হাবিবুর রহমান আভিযোগ করেন, অপারেশনের সময় প্রসূতির জরায়ু কেটে ফেলা হয়েছে। কোন ডাক্তার সিজার করলো তা আমরা জানতে পারি নি। নবজাতকের প্রসাবের রাস্তা সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেলার কারণে তার সন্তাান মারা গেছে বলে অভিযোগ তার।
কোন ডাক্তারকে দিয়ে সিজার করা হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের কর্তব্যরত স্টাফ নার্স জেসমিন আক্তার কথা বলতে রাজি হননি। হাসপাতালটির পরিচালক লাপাত্তা রয়েছে। বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
বোনারপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই এনায়েত কবির বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে যা করার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা করবেন। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহযোগিতা করব। সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও হাসপাতালে সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে গত দেড় মাস আগে উপজেলার কচুয়া গ্রামের আবদুল ওয়াহেদের পুত্র আইদুল হক তার স্ত্রী মুর্শিদা বেগমকে প্রসব বেদনা নিয়ে ওই বোনারপাড়া ডিজিটাল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে সিজারিয়ান অপারেশনের পরামর্শ দেন। সে মোতাবেক সন্ধার পর সিজার করা হলে ক্রমেই মুর্শিদার পেট ফুলতে থাকে। রাত গভীর হয়ে আসলেও তাকে কোন ভালো চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলেও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় উপায়ান্তু না পেয়ে পরদিন সকালে তাকে বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মৃত্যু সাথে লড়ে প্রায় একমাস চিকিৎসার পর কোন মতে পঙ্গুর ন্যায় জীবন কাটাচ্ছেন ওই প্রসুতি।
একই ভাবে ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল উপজেলার ভরতখালী এলাকার লিমন মিয়ার স্ত্রী রশিদা বেগমকে প্রসবের ব্যথা নিয়ে বোনারপাড়া মাতৃসদন (বর্তমানে বোনারপাড়া ডিজিটাল হসপিটাল) নামের ওই বেসরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ভর্তির পর সাড়াটা দিন কেটে গেলেও কোন চিকিৎসক কিংবা নার্স রোগীকে দেখতে আসেনি। একপর্যায়ে গৃহবধুর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক স্বাস্থ্য সহকারী নামধারী ভুয়া চিকিৎসক আজগর আলী নিজেই একটি রুমে নিয়ে প্রসব করানোর চেষ্টা করে। ব্যাপক টানাটানি করায় নবজাতকের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ওই মাকে গাইবান্ধা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এনিয়ে ব্যাপক হইচই শুরু হয় এলাকায়। এ ঘটনায় অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউএনও অফিস কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং গাইবান্ধা সিভিল সার্জন অফিস কর্তৃক ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি (স্বারক নং-সিএস/গাঃ/প্রশাঃ/২০১৯/৯৪৬/১৬) গঠন করা হয়। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর অবারও রেজিস্ট্রেশন ভুক্ত কোন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়মের কোন তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে ওই বোনারপাড়া ডিজিটাল হসপিটালে। সিজারিয়ান অপারেশন, এ্যাপেনটিক্স, টিউমার সহ সব ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে এই নাম সর্বস্ব চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে।