হেফাজতের ডাকা হরতালের দিন সরাইলের বিশ্বরোড এলাকায় খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে অগ্নিসংযোগের মূলহোতা জাকারিয়া আহমেদ প্রীতম (২৮) ও তার ছোট ভাই মনির উদ্দিনকে (২৩) গ্রেপ্তার করেছে এন্টিটেরি-রিজম ইউনিট (এটিইউ) পুলিশের সহায়তায় সরাইল থানা পুলিশের একটি দল। গত শনিবার বিকেলে ঢাকা বিভাগের গাজিপুর এলাকা থেকে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রীতম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের প্রয়াত নাছির উদ্দিনের ছেলে। হরতালের দিনের সকল ভিডিও ফুটেজে প্রীতমের তান্ডবলীলা একবারে পরিস্কার। পুলিশের কাছে পেট্রোল দিয়ে এপিসি পুড়িয়ে দেওয়া সহ অন্যান্য তান্ডবে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করেছে প্রীতম।
পুলিশ, মামলার এজহার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২৮ মার্চ হেফাজতের ডাকা হরতালের দিন সকাল থেকেই পিকেটিং-এ নেমেছিল প্রীতম ও তার ভাই মনির। সরাইলের কালিকচ্ছ বাজার, সরাইল সদরের হাসপাতালের মোড় ও সরাইলের প্রধান সড়কের বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল প্রীতম। লাঠিসোটা হাতে অপরিচিত কিছুর কিশোর যুবকের উশৃঙ্খল আচরণ ভাবিয়ে তুলে সরাইলের হেফাজত নেতাদের। পরে ওইদিন সকাল ১১টার দিকে হেফাজত ইসলামের ডাকা সরাইলের হরতাল স্থগিত ঘোষণা করেন। সেখান থেকে দ্রƒত একটি দল বিশ্বরোড এলাকায় চলে যায়। সেখানে অবস্থানরত কর্মীদের সাথে যোগ দিয়ে তান্ডব চালায়। একপর্যায়ে বিশ্বরোড খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানায় হামলা চালায়। থানার বাহিরে থাকা পুলিশের এপিসি সহ বেশ কয়েকটি গাড়ি পুঁড়িয়ে দেয়। প্রীতম লাফ দিয়ে এপিসি’র উপরে ওঠে। পেট্রোল ঢেলে এপিসিতে আগুন জ¦ালিয়ে নাচতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরই থানায় আগুন জ¦ালিয়ে দেয় হরতালকারীরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছুড়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে কুট্রাপাড়া গ্রামে আল-আমীন ও খাঁটিহাতা গ্রামের কালন মিয়া নামের দুই কিশোর মারা যায়। বাম পায়ের নীচে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরূতর আহত হয় প্রীতম। স্বজন ও তার সহযোগিদের সহায়তায় চিকিৎসার জন্য চলে যায় ঢাকার উত্তরায়। সেখানে প্রাইভেট হাসপাতালে পায়ের চিকিৎসা করে। পরে গাজিপুরে ভাড়া বাসায় ওঠে অবস্থান করতে থাকে। ৩১ মার্চ সদর মডেল থানার এস আই মো. নূরূল আমীন বাদী হয়ে ৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরো ৭/৮ শত লোককে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। আর ঘটনার পর থেকে ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িদের সনাক্ত করার কাজ শুরূ করে পুলিশ। সরাইলের মিছিলের ভিডিও ফুটেজের ছবির সাথে বিশ্বরোডে পুলিশের এপিসিতে আগুন জ¦ালিয়ে লাফিয়ে আনন্দে আত্মহারা সেই ছবিটি মিলে যায়। পুলিশ নিশ্চিত হয় তার বাড়ি সরাইলে। শুরূ করেন তদন্ত। একসময় পুলিশ প্রীতমের ঠিকানা, বাবা ও স্বজনদের পরিচয় পায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় গোপনে সোর্স ব্যবহার করে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কৌশলে প্রীতমের অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। গত ৮ এপ্রিল শনিবার সরাইল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কবির হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের নিয়ে গাজিপুরে অভিযান চালিয়ে প্রীতম ও মনিরকে গ্রেপ্তার করেন। তাদেরকে রাতেই নিয়ে আসেন সরাইল থানায়। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রীতম হরতালের দিনের তান্ডবে ও পুলিশের এপিসি পুঁড়িয়ে দেয়ার দায় স্বীকার করেছে। গতকাল রোববার ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে জেলার সিআইডি পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে গেছেন।
কে এই প্রীতম?
সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের পশ্চিম পাড়ার মৈশান বাড়ির প্রয়াত নাছির উদ্দিনের ছেলে প্রীতম। মা মোছা. শিরিনা বেগম। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে প্রীতম সবার বড়। বিয়ে করেননি প্রীতম। দরিদ্র ঘরের সন্তান প্রীতম পড়া লেখা করতে পারেনি। তার বাবা নাছির উদ্দিন পাকিস্তানের প্রতি দূর্বল ছিলেন। নব্বই দশকের আগে থেকেই তিনি নিয়মিত পাকিস্তানে যাওয়া আসা করতেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে নাছির উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। সংসারের হাল ধরতে ট্রাক্টর চালাতে শুরূ করে প্রীতম। কোন রকমে খেয়ে পড়ে ভালই চলছিল প্রীতমদের পরিবার। পুলিশের জিম্মায় থাকা প্রীতম বলেন, সেই দিন সকালে আমি নাসিরনগর যাওয়ার উদ্যেশ্যে বের হয়। কালিকচ্ছ শহীদ মিনার এলাকায় এসে দেখি হুজুররা বক্তব্য দিচ্ছেন। দেশ রক্ষায় জিহাদে যোগ দেওয়ার আহবান জানাচ্ছেন। ব্রেইনটা কেমন যেন ওয়াশ হয়ে গেল। জিহাদের ফজিলতের কথা শুনে সকলের সাথে যোগ দিলাম। সরাইল হাসপাতালের মোড়ে গিয়েও জিহাদি বক্তব্য শুনলাম। আরো দূর্বল হয়ে পড়লাম। পরে সকলের সাথে দৌঁড়ে বিশ্বরোড মোড়ে গেলাম। সেখানেও জিহাদ। আমার কি যে হয়ে গিয়েছিল আমি কিছুই জানি না। লাফ দিয়ে গাড়িতে (এপিসি) ওঠলাম। কে যেন ঢিল দিয়ে আমার হাতে পেট্রোলের ক্যান দিল। পেট্রোল ঢেলে আগুন জে¦লে দিলাম। হঠাৎ বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলাম। কেন আমি এমন করলাম? আমি বেঁচে নাে থেকে মরে গেলেই ভাল হত।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা সিআইডি’র সহকারি পুলিশ সুপার মো. ইসমাঈল বলেন, দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে গাড়ি পুঁড়িয়ে দেওয়ার মূলহোতাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। আজ প্রীতমকে আদালতে সোপর্দ করব। আদালতই পরবর্তী সিদ্ধান্ত দিবেন।