সরকার দেশে পুরনো গাড়ি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয়ভাবে গাড়ি উৎপাদন করতে চাইছে। ওই লক্ষ্যে সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় ‘অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০২০’ নামে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। তাতে পর্যায়ক্রমে দেশে পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধের কথা বলা হয়েছে। তবে ওই নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ছোট হতে শুরু করেছে পুরনো গাড়ির বাজার। পুরনো গাড়ির আমদানিকারকদের মতে, সরকারের বৈষম্যমূলক রাজস্ব নীতির কারণে গাড়ি আমদানি কমতে শুরু করেছে। আর অটোমোবাইল নীতিমালার মাধ্যমে পুরনো গাড়ির বাজারটিকে পুরোপুরি ধ্বংসের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। যদিও দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন পুরনো গাড়ির চেয়ে নতুন গাড়ি কেনার দিকে বেশি ঝুঁকছে। পুরনো গাড়ি আমদানি ও বিক্রির পরিসংখ্যানেই তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বারভিটা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বাজারে দুই ধরনের গাড়ি (প্রাইভেট কার) বিক্রি হয়। একটি ‘ব্র্যান্ড নিউ’ বা নতুন, আরেকটি ‘রিকন্ডিশন্ড’ বা পুরনো। দুই ধরনের গাড়ি বিক্রি হলেও এদেশে গাড়ির বাজারটির সিংহভাগই পুরনো গাড়ির দখলে। মোট বিক্রি হওয়া গাড়ির ৮০ শতাংশই পুরনো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারটি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বিপরীতে বাড়ছে নতুন গাড়ি বিক্রি। গত তিন বছরের ব্যবধানে দেশে পুরনো গাড়ি বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৩ সালে ১০ হাজার ৯১৯টি পুরনো গাড়ি আমদানি করা হয়েছিল। একইভাবে ২০১৪ সালে ১৩ হাজার ৮২৫টি, ২০১৫ সালে ১৮ হাজার ৬৬৪টি, ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৫৫৮ ইউনিট রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়। ২০১৭ সালে ২৩ হাজার ৮৯১ ইউনিট রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ও ২০১৮ সালে ১৭ হাজার ৪০১টি পুরনো গাড়ি আমদানি হয়। ২০১৯ সালে আমদানি করা পুরনো গাড়ির সংখ্যা ছিল ১৩ হাজারের মতো। সর্বশেষ ২০২০ সালে আমদানি হওয়া পুরনো গাড়ির সংখ্যা ১২ হাজারের নিচে চলে এসেছে। মূলত সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতির কারণেই দেশে পর্যায়ক্রমে পুরনো গাড়ি আমদানি ও বিক্রি কমে যাচ্ছে। পুরনো গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ১২৮ শতাংশ। গাড়ির সিসি ভেদে ওই হার বাড়তে থাকে। যে কারণে আমদানি করা পুরনো গাড়ির দাম ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দামের দিক দিয়ে নতুন গাড়ির সঙ্গে পুরনো গাড়ি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকার আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক অটোমোবাইল শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত করতে চায়। সেজন্য তৈরি করা হচ্ছে ‘অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা’। তাতে পর্যায়ক্রমে পুরনো গাড়ি (রিকন্ডিশন্ড কার) আমদানি বন্ধ করে স্থানীয় উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তবে নীতিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই দেশে পুরনো গাড়ির বাজারটি ছোট হয়ে আসছে। পুরনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে পুরনো গাড়ি আমদানি হয়েছে ১২ হাজারেরও কম। অথচ দু-তিন বছর আগেও বছরে এর প্রায় দ্বিগুণ পুরনো গাড়ি আমদানি হতো। সরকার অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়নের যে নীতিমালাটি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, তাতে স্থানীয়ভাবে গাড়ি উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। নীতিমালায় স্থানীয় উৎপাদকদের প্রণোদনা, বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ তৈরি, স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি, অটোমোবাইল নির্মাণ খাতে দক্ষ জনবল তৈরি, দেশে গাড়ির বাজার উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। নীতিমালায় স্থানীয় অটোমোবাইল শিল্পের উন্নয়নের জন্য ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত কৌশলগত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে শুধু ব্যক্তিগত গাড়িই নয়, স্থানীয়ভাবে থ্রি-হুইলার, বাস, ট্রাকসহ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের গাড়ি সংযোজন ও উৎপাদনের রূপরেখাও দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম বছরে স্থানীয়ভাবে সব ধরনের গাড়ি ১০ শতাংশ উৎপাদন করা হবে। তৃতীয় বছরে দেশে উৎপাদিত গাড়ির পরিমাণ বাড়িয়ে নেয়া হবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশে। পঞ্চম বছরে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, অষ্টম বছরে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ, আর দশম বছরে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত গাড়ি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের জন্য কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছে। আর অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে পুরনো গাড়ির আমদানি বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৫ বছর পর্যন্ত পুরনো গাড়ি আমদানির অনুমতি রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নীতিমালা কার্যকরের পর থেকে ধীরে ধীরে পুরনো গাড়ি আমদানি কমিয়ে দেয়া হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে ব্যবসায়ীরা কেবল ৩ বছর পর্যন্ত পুরনো গাড়ি আমদানি করতে পারবে। পঞ্চম বছরে এক বছরের বেশি পুরনো গাড়ি আমদানি করতে দেয়া হবে না। আর ষষ্ঠ বছরে গিয়ে পুরনো গাড়ি আমদানি একেবারে বন্ধ করে দেয়া হবে।
এদিকে পুরনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক জানান, পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধের পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত নয়। বারভিডা দেশে গাড়ি উৎপাদনের বিরোধিতা করছে না। কিন্তু সেজন্য পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনাটি কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। তাতে পুরনো গাড়ির ব্যবসায়ীরা একদিকে যেমন ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনি দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা পুরনো গাড়ির ক্রেতা, তারাও বঞ্চিত হবে।