আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে কর আরোপ ও করহার নির্ধারণ না করার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এর পরিবর্তে প্রশাসনিক দক্ষতায় কর ফাঁকি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ বন্ধের পরামর্শ তাদের। রোববার নাগরিক প্লাটফর্ম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘জাতীয় বাজেট ২০২১-২২: পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী থাকছে’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন আইন ও সালিশি কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। মূল প্রবন্ধে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী বাজেটে নতুন কোনো কর আরোপ কিংবা করহার বাড়ানো উচিত হবে না। বরং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে করের আওতা বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি কমিয়ে আনতে হবে। যারা কর দেয় না, ফাঁকি দেয়, তাদের করের আওতায় কীভাবে আনা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য রাজস্ব বোর্ডের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ছাড় দেয়া হয়ে থাকে। এসব ছাড়ের বিষয় বাদ দিয়ে কীভাবে সবাই যাতে কর ফাঁকি না দিতে পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে শ্রমঘন শিল্পের ক্ষেত্রে কর নিয়ন্ত্রণ রাখাও জরুরি। অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগকে যুক্তিহীন উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিহীন, নৈতিকভাবে গর্হিত এবং রাজনৈতিকভাবেও অপকারী অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ। একইভাবে যারা অর্থ পাচার করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় না আনা এবং পাচার করা অর্থ ফেরত না আনাও একটি ভয়াবহ রকম যুক্তিহীন ও গর্হিত ব্যাপার। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পাচার হওয়ার অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নেয়া সত্যিই দুঃখজনক। এ ব্যাপারেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের ফলে সৎ করদাতাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা থাকলেও সেটিও ভঙ্গ হচ্ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ শুধু অর্থনৈতিকভাবেও অযৌক্তিক নয়, সাম্যের পরিপন্থীও। যে তিনটি খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছে, সে খাতগুলো থেকে নতুন কিছু উৎপাদন হয় না। অনুৎপাদনশীল খাতেই এটি বিনিয়োগ হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও একটি শ্রেণীর জন্য এ ধরনের বিশেষ সুবিধা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত অর্থবছর আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে পার করেছি। ওই বছর কর আদায়ের হার ও সরকারের ব্যয় কমেছিল। চলতি অর্থবছরেও কর আদায় ও সরকারি ব্যয়ের হার প্রয়োজনের তুলনায় কমেছে। কর আদায় যেখানে উচিত ছিল ১০-১২ শতাংশ হারে, সেখানে প্রথম ৯ মাসে ৭ শতাংশের কিছু বেশি কর আদায় হয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ দেয়াকে করের অন্যায্যতা হিসেবে উল্লেখ করেন রাশেদা কে চৌধুরী। এজন্য করের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিতের তাগিদ দেন তিনি। পাশাপাশি শিক্ষা খাতের দিকেও নজর দেয়ার আহ্বান জানান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এ উপদেষ্টা। শিক্ষা খাতের বাজেটের বিষয়টি উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বাংলাদেশের শিক্ষা খাত অবহেলিত রয়ে গেছে। মাধ্যমিক (এমপিওভুক্ত নয়) হাজার হাজার শিক্ষক অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন। তাদের এ পেশায় ধরে রাখতে আগামী বাজেটে কী থাকছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, তার কোনো তথ্য কেউ জানে না। করোনার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। কর্মহীন, অর্থহীন, খাদ্যহীন দিনপার করা এসব মানুষের বিষয়ে এবারের বাজেটে বিশেষ গুরুত্বারোপ করার পরামর্শ দেন শাহীন আনাম। তিনি বলেন, বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তা খুবই অপ্রতুল। সে টাকাটা সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কিনা, তার নজরদারি হয় না। প্রান্তিক মানুষের জন্য বরাদ্দের টাকা সঠিকভাবে নজরদারি করা উচিত বলে মত দেন তিনি। করোনায় শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে উল্লেখ করে শাহীন আনাম বলেন, আসছে বাজেটে শিশুদের জন্য কী থাকছে সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার বিষয়। করোনার কারণে নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকরভাবে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। এসব সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওয়েবিনারে অন্যান্যের মধ্যে ব্র্যাকের ভাইস চেয়ারম্যান ড. মোশতাক রাজা চৌধুরী, বিল্ডের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রমুখ।