করোনা প্রাদুর্ভাবে সরকারের রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাবে ব্যয় করার সঙ্গতি কমে গেছে। গত অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের চিত্র ছিল করুণ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো দূরের কথা, আগের বছরে যে অর্জন ছিল, তাও সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার মতো। তাও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। এমন অবস্থায় দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন চালু রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সব প্রকল্পে অর্থায়নও সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্যই চলতি অর্থবছরে আর নতুন কোনো পূর্তকাজ বা স্থাপনা তৈরির কার্যাদেশ না দেয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অর্থের অভাবে বর্তমানে কয়েকটি টওকল্প ছাড়া বাকিগুলো ঢিমেতালে চলছে। অর্থসঙ্কটের কারণে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হলেও সর্বশেষ তথ্যে সামগ্রিক বাজেটের বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৩ শতাংশ। এমন অবস্থায়ই প্রায় শেষের পথে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া। করোনাজনিত লকডাউনে স্থবির হওয়া অর্থনীতি আগামী দুই-তিন বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সন্দিহান। মূলত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির জন্য অনেকেই করোনাকে দায়ী করছে। এ সময় লকডাউনে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাধাগ্রস্ত হয়েছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে গিয়েবেসরকারি খাত হিমশিম খাচ্ছে। লকডাউন দিয়ে সরকারি অফিস কার্যত বন্ধ রাখায় বেসরকারি খাতের চাকাও মন্থর হয়ে পড়েছে। এমনকি লকডাউনের কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অফিসের বকেয়া বিলও পায়নি। ফলে ঈদের আগে বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানায় বেতন-বোনাস দেয়া নিয়ে মালিকরা উৎকণ্ঠায় রয়েছে। তাতে করে সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে বেসরকারি খাত চাঙ্গা থাকলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়তো। পাশাপাশি রাজস্ব খাতে সংস্কারও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সংস্কার না করে শুধু উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নিলেই রাজস্ব আদায় বাড়বে না বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। তাদের মতে রাজস্ব খাতে সংস্কার দরকার। তা করা গেলে আদায় বাড়বে।
সূত্র জানায়, জিডিপির আকার বাড়লে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অথচ কর-জিডিপির অনুপাত কমে গেছে। জিডিপির ট্র্যাপে পড়ে গেছে কর-জিডিপির অনুপাত, যা এখন সাড়ে ৮ শতাংশ। অথচ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী তা ১৪ শতাংশ হওয়ার কথা। যদিও নীতিনির্ধারকদের অনেকের মতে, এখানকার লোকজন ঠিকমতো কর না দেয়ার কারণে কর-জিডিপির অনুপাত কম। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন এদেশের সবাই কর দিচ্ছে। সরকারের কর আদায়ের সহজ মাধ্যম পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হওয়ায় ধনী-গরিব সবাই এখন করজালে বন্দি। বাজারমূল্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রাজস্ব না বাড়লে ধরে নিতে হবে তা পশ্চাৎমুখী। বাস্তবেও তাই হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকেই সরকার নানাভাবে কাটছাঁট বা কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হেঁটেছে। উন্নয়ন ব্যয়ও প্রতি বছরের মতো কমিয়েছে। তারপরও আয় কম হওয়ায় নতুন করে চলতি বছরের পূর্তকাজের কার্যাদেশ প্রদান বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আলোকে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২০২১) অবশিষ্ট সময়ে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় নতুন কোনো পূর্তকাজ (নির্মাণ/স্থাপনা)-এর কার্যাদেশ প্রদান করা যাবে না। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় এই পরিপত্রের বাইরে থাকবে।
এদিকে সরকারের ব্যয়ের চাপ কমাতে কোনোভাবে নতুন করে অতিরিক্ত বরাদ্দ না দেয়ার কথা বছরের শুরুতেই বাজেট সংশোধনের আগে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়। আর কোনোভাবেই উন্নয়ন খাতের অব্যয়িত অর্থ ভিন্ন খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে এ ধরনের মোট ২৪ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। মূলত, অগ্রাধিকার খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তে সরকারের মূল লক্ষ্য। ফলে ব্যয় নিয়ন্ত্রণেই বেশি জোর দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ৮ মাস, অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পরিচালনা খাতে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ৪১ দশমিক ৯২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। যা বিগত বছরগুলোর গড় (৪৫ শতাংশ) বাস্তবায়ন থেকে অনেক কম।