সঠিক তথ্য অপ্রিয় হলেও সত্য। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নিবাচন হলে তিনিই সম্ভবত আজ থাকতেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ, ২০১৪ সালে জানুয়ারি মার্কায় অনুষ্ঠিত গণতন্ত্রের ক্লাবের নির্বাচনী সার্কাস। ওই নির্বাচনী সার্কাসে তিনি অংশ না নেয়ায় ১৫৪ টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পাওয়া যায়নি। ফলশ্রুতিতে ফাঁকা মাঠে নির্বাচনী গোল দিয়ে অনেকেই ম্যারোডনার নিছক কৃতীত্ব অর্জন করে হাল জমানায় যক্ষের ক্ষমতা মওকা মারার সুর্বণ সুযোগ পেয়েছেন! অপরদিকে, জীবনের সায়াহ্নে চরম অসুস্থ সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতিটুকুও মিলছে না তাঁর ভাগ্যে। অথচ দেশের প্রচলিত ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১ ধারা আর রীতি অনুসারে এই অনুমতি পাওয়ার যথেষ্ট অধিকার রয়েছে তাঁর।
জামিন না দিয়ে কারাগারে রেখে দেওয়া এক ধরনের বিচারপূর্ব শাস্তিই বটে। আমাদের দেশে তাই বড় ধরনের অপরাধের মামলা থাকলেও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় তিনটি বিবেচনায় জামিন দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
১. কেউ শারীরিকভাবে অক্ষম বা অসুস্থ হলে, নারী হলে বা ১৬ বছরের নিচে হলে।
২. মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে এমন মামলা ছাড়া অন্য মামলায় কেউ অভিযুক্ত হলে।
৩. কারও অপরাধ সম্পর্কে অধিকতর তদন্ত করার যথেষ্ট কারণে থাকলে।
জামিনসংক্রান্ত নিম্ন আদালতের অতীতের রায়গুলোয় শুধু আসামির পালিয়ে যাওয়ার বা বিচারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার আশঙ্কা থাকলে (যেমন সাক্ষীকে হুমকি দেওয়া) জামিন প্রদান করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আইনের এসব বিধান থাকার পর রন সিকদার (এবং সরকারি দলের অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি) জামিন পেতে পারলে প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় ছাত্র অধিকারের ছেলেরা জামিন পাবে না কেনো? কেনো জামিন পাবে না ছাত্রদল বা অন্য সংগঠনগুলোর বা ভিন্নমতাবলম্বী কোনো মানুষ?
একটি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেয়া বড়ই বেমানানই বটে। আদালত কর্তৃক দ-প্রাপ্ত আসামিকে বিদেশে পাঠানোর নজির যে বাংলাদেশে নেই, এটা সত্য নয়। ১৯৭৯ সালে কারাবন্দী আ স ম আবদুর রব চিকিৎসার জন্য পশ্চিম জার্মানি যান। তৎকালীন সরকার এই ব্যবস্থা করে।’
দ-প্রাপ্ত আসামীকে পাসপোর্ট দিতে কোনো বাঁধা নেই। একইভাবে দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর (শর্ত শিথিল করলে) বিদেশে যেতেও কোনো আইনি বাঁধা নেই।
জবভবৎবহপব: ২ ইখঈ (অউ) ১৫৭ ্ খঊঢ/ইউঅউ/০২৪২/১৯৯৬।
অবশ্য বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়ার বিষয়টিকে সরকারের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির ‘হিসাব-নিকাশ’ এর জটিল সমীকরণ বলেই ধারণ করা যায়।
প্রথমত, শুরুতে সরকারি মহল হয়তো ধরে নিয়েছিল যে খালেদা জিয়ার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় কোনো অঘটন ঘটে গেলে এর দায় সরকারের ওপর বর্তাবে। সে জন্য খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের আবেদনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ইতিবাচক মনোভাব দেখান।
দ্বিতীয়ত, গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে সরকার খালেদা জিয়ার দ- স্থগিত করে কারামুক্তি দিয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটি ছিল সরকারের রাজনৈতিক দায়মুক্তি বা ঝুঁকি এড়ানোর কৌশল। এখন আবার সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় বিদেশে পাঠানোর কথা নয়। সে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে সরকার তাঁকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিশ্চয়ই সরকার তার রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করবে।
দুনিয়ায় ক্ষমতার মোহে যারা অন্ধত্ববরণ করে, তাদের কাছে আল্লাহ তা'য়ালার হুকুম মানতে কোনো বাছ-বিচার পরিলক্ষিত হয়না।
আল্লাহ তা’য়ালার অন্যতম একটি নাম হচ্ছে ‘হাকিম’ বা ন্যায়বিচারক। তিনি হচ্ছেন ‘আহকামুল হাকিমীন’। অর্থাৎ সব বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক। আর পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব প্রদান করে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে অনেক জায়গায় মানুষকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।
সূরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে- 'নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট ! নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।”
অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে, এই আয়াতটি উসমান বিন ত্বালহা (রা.)-এর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তিনি বংশগতভাবেই কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধায়ক এবং তার চাবি-রক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা.) কা’বা শরীফে উপস্থিত হয়ে তাঁর হাতেই আবার কা’বা শরীফের চাবি হস্তান্তর করে বললেন, ‘এগুলো তোমার চাবি। আজকের দিন হল, অঙ্গীকার পূরণ ও পুণ্যের দিন’। (ইবনে কাসীর)
এই আয়াতে লক্ষণীয় যে, কোরআনুল কারীম আমানতের বিষয়টিকে ব্যাপক অর্থ বহন করে। কারো নিকট অপর কারো কোন বস্তু বা সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধুমাত্র আমানত নয়। বরং রাষ্ট্রীয় যত দায়িত্বশীল পদ ও পদমর্যাদা রয়েছে, সেসবও আল্লাহ তা'আলারই আমানত। পদ ও দায়িত্ব যোগ্য লোকদেরকেই যেন দেওয়া হয়। কেবল রাজনৈতিক ভিত্তিতে। অথবা বংশ, গোত্র ও জাতিগত ভিত্তিতে। কিংবা আত্মীয়তা বা অঞ্চল। কিংবা দল ভিত্তিক নিয়মে পদ ও দায়িত্ব দেওয়া এই আয়াতের পরিপন্থী।
সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
'হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ। যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ্ উভয়েরই ঘনিষ্টতর। কাজেই তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল বা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।'
এই আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারকে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করার এবং ন্যায় অনুযায়ী সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতি তাকীদ করছেন। যদিও তার কারণে তাকে অথবা তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে ক্ষতির শিকার হতে হয় তবুও। কেননা, সব কিছুর উপর সত্যের থাকে কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য। যেমনটা কোরআনের বিভিন্ন সূরায় আল্লাহ ন্যায়বিচারের তাগিদ দিয়েছেন, যেমন ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত। (সূরা মায়েদা-৮)
আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায় কথাই বলবে, তোমার নিকট আত্মীয় হলেও’ (আন‘আম-১৫২)।
‘তোমরা দুটো দলের মাঝে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে ফায়সালা করে দেবে এবং তোমরা ন্যায় বিচার করবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় বিচারকদের ভালবাসেন।’ (সূরা হুজরাত-৯)।
ন্যায়বিচারের পাশাপাশি আল্লাহ তাঁর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করার জন্যও মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর যারা তার বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না কুরআন মাজীদে তাদেরকে কাফির, যালিম ও ফাসিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে (সূরা মায়েদাহ- ৪৫-৪৭)।
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে হাদিসেও অসংখ্য নজির পাওয়া যায়। একদিন অভিজাত বংশের ফাতিমা নামের এক নারী চুরি করে বসল। উসামা (রা.) তাকে মাফ করে দেওয়ার সুপারিশ করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) কঠোর ভাষায় বললেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাঁতি সমূহ এজন্যই ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের সাধারণ লোকরা চুরি করলে শাস্তি কার্যকর করত। কিন্তু অভিজাত লোকরা চুরি করলে তাদের কোন শাস্তি দিত না। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন। যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম।[বুখারী-৩৭৩৩, মুসলিম-১৬৮৯।]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিচারক তিন শ্রেণীর। তন্মধ্যে দু’শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী এবং এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী। যিনি জান্নাতে যাবেন তিনি হলেন ঐ বিচারক, যিনি হক বুঝে সে অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করেন। দ্বিতীয় প্রকার ঐ বিচারক, যিনি সত্যকে জানেন কিন্তু বিচার-ফায়সালায় যুলুম করেন, তিনি জাহান্নামী। তৃতীয় প্রকার বিচারক তিনি, যিনি অজ্ঞতার উপর মানুষের বিচার-ফায়সালা করেন, তিনিও জাহান্নামী’।[আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত-৩৭৩৫, সনদ সহীহ।]
বিচারকগণের উদ্দেশে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো বিচারক যেনো রাগান্বিত অবস্থায় দু’জনের মধ্যে বিচার-ফায়সালা না করে’।[বুখারী-৭১৫৮।] বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় কখনও কখনও ফায়সালা দানকারী কিংবা সাক্ষ্য দাতাকে বিভিন্ন কারণে প্রলোভীত ও প্ররোচিত হতে দেখা যায়। অথচ আল্লাহ ইনসাফের সাথে বিবাদ মিমাংসাকারীকে ভালোবাসেন। আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালোবাসেন (সূরা মায়েদা-৪২)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, সাত শ্রেণীর লোকদের আল্লাহ সেই কঠিন দিনে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে প্রথমটিই হচ্ছে: ন্যায়বিচারক। (সুনানে নাসায়ী-৫৩৭৯)।
আমরা মনে করি, ‘যেখানে ফৌজদারি মামলার দ-প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাজা মওকুফ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না দেওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ দেখি না।’
তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার বিচারটাকে মানুষ অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিচার মনে করে না। এটা রাজনৈতিক স্বার্থের বিচার। আইনের যে ধারায় তাঁর দ- স্থগিত করা হয়েছে, সে ধারাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার দরকার ছিল।
ভাবতে অবাক লাগে যে, মানুষের জীবন নিয়ে এ কেমন রাজনীতি এগিয়ে যাওয়ার ডিজিটাল রাষ্ট্রে? অথচ জীবন প্রদ্বীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রসালো গলায় চাউর করা হবে, 'তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিককে হারালম।' ফোন করাও হতে পারে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত মাতৃবিয়োগে শোকাতুর পুত্রকে। মাসির চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে পিসির দরদে দোষারোপ করাও হতে পারে, 'তাঁর উন্নত চিকিৎসা না হওয়ার জন্য খোদ তাঁরই দলীয় নেতারা দায়ি।' লোক দেখানো বাহারি আয়োজনও হতে পারে, শোক প্রকাশের আর সৎ কাজ সম্পন্নে। কী বিচিত্র রাজনীতি! কী অদ্ভুত ক্ষমতার আস্ফালন!! রাজনীতিতে কী বিচিত্র শোক বিলাপ!!!
পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদেরকে সমস্ত প্রলোভন, আত্মীয়তা। স্বজন ও অঞ্চল প্রিয়তা। প্রভাব-ভয়-ভীতি, পক্ষপাতিত্ব। পদ-পদবী ও দলীয় আনূগত্যের উর্ধ্বে থেকে। আমাদেরকে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করার তৌফিক দান করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, কলামিস্ট ও দৈনিক সংবাদের সাবেক সহসম্পাদক।