করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানির গতি বাড়ায় ধাপে ধাপে বন্দরের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম উন্নতি হচ্ছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে আসায় চট্টগ্রাম বন্দরে তার প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় বন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম আগের মতো গতি হারায়নি। বরং বাল্ক কার্গো (খোলা পণ্য) উঠানামায় লক্ষ্যণীয় অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষের ধারণা, অর্থবছর শেষে সেখানে ৭ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে সমুদ্রপথে পণ্যের ৯৩ শতাংশই আমদানি-রফতানি হয়। কনটেইনারবাহী জাহাজ ও খোলা পণ্যবাহী বাল্ক কার্গো- দুই ধরনের জাহাজে করেই আসা-যাওয়া পণ্য ওঠা-নামার ভিত্তিতে বন্দরের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়। সিমেন্ট, ইস্পাতসহ খাদ্যশস্য ও সাধারণ পণ্য বাল্ক কার্গো বা খোলা পণ্যবাহী জাহাজে আমদানি হয়। আর শিল্প-কারখানার কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও বাণিজ্যিক পণ্য কনটেইনারে করে আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ৬টি জেটি দিয়ে বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম চলছে। বেশির ভাগ বাল্ক কার্গো বহির্নোঙরে হ্যান্ডলিং হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৯ কোটি ৬৭ লাখ থেকে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৭২ টন খোলা পণ্য (কার্গো) বন্দরে ওঠা-নামা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ৮ কোটি ৯৮ লাখ ২৬ হাজার ১১৫ টন। ওই হিসাবে ১০ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশ। করোনা সংকটকালীন সময়েও বাল্ক কার্গো প্রবৃদ্ধিতে মূলত অবদান রেখেছে স্ক্র্যাপ, পাথর ও কয়লা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে বন্দরে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৭২ টন খোলা পণ্য (কার্গো) ওঠা-নামা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৯ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৫ টন। ওই হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
সূত্র জানায়, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কাকালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও শিল্পপণ্য আমদানি স্বাভাবিক থাকলেও কমেছে কমার্শিয়াল আমদানি। তাতে কনটেইনারের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম প্রায় গত অর্থবছরের কাছাকাছিই রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ২০ ফুট দীর্ঘ হিসেবে ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪৭৬ একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১৯১ একক। মাসভিত্তিক হিসাবে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ হ্যান্ডলিং হয়েছিল জানুয়ারিতে ২ লাখ ৮০ হাজার ২২২ একক। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সবচেয়ে কম ২ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৩ একক হ্যান্ডলিং হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ৩০ লাখ ৪ হাজার ১৪২ একক। আগের অর্থবছরে যা ছিল ২৯ লাখ ১৯ হাজার ২৩ একক। অর্থাৎ তখন কনটেইনারবাহী পণ্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালট্যান্সি (এইচপিসি) প্রণীত চট্টগ্রাম বন্দরের ৩০ বছরমেয়াদি মহাপরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ন্যূনতম, মধ্যম ও সর্বোচ্চ- ওই তিনভাবে ধারণা দেয়া হয়েছে। তাতে ন্যূনতম হলে ৫ শতাংশ, মধ্যম ৭ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ শতাংশ। যদি দেশ স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে অর্থাৎ বড় কোনো বিপর্যয় না ঘটে, তবে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। আর যদি দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা কিছুটা কমে আসে, সেক্ষেত্রে তা মধ্যম অর্থাৎ ৭ শতাংশে নেমে আসবে। আর যদি বড় আকারে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণাত্মক প্রভাব, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, সুশাসনের অভাব প্রভৃতি বিষয় ঘটে, তবে তা ন্যূনতম অর্থাৎ ৫ শতাংশে নেমে আসবে। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ও কনটেইনারবিহীন (বাল্ক কার্গো) দুই ধরনের পণ্যই ওঠানো-নামানো হয়। চলতি অর্থবছর শেষে বন্দরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ বা এর কাছাকাছি হওয়ার কথা। এমন হলে করোনায় আমদানি-রফতানি তথা বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতায় তাকে সাফল্য হিসেবেই ধরে নিতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, বন্দরের আমদানির একটি বড় অংশ বাণিজ্যকেন্দ্রিক। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ভোক্তারা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা বিলাসবহুল পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থেকেছে। তবে স্ক্র্যাপ, পাথর ও কয়লা ছাড়াও সরকারি চলমান মেগা প্রকল্পের যন্ত্রপাতির আমদানিতে বাল্ক কার্গোর হ্যান্ডলিং ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের চিত্রটির একটি সামঞ্জস্য রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে এবারের লকডাউনে কারখানার কার্যক্রম যদি বন্ধ করে রাখা হতো, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেত। করোনা ভাইরাসের কারণে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে অনেক দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তখন অনেক ক্ষেত্রেই ঋণপত্র খোলা হলেও দেশে পণ্য আসেনি। পরে অবশ্য সংকট কাটতে থাকে। বর্তমানে বন্দরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এখন কনটেইনার থেকে ৩ গুণ বেশি আসছে কনটেইনারবিহীন (বাল্ক) পণ্য। খাদ্যশস্যের প্রায় পুরোটাই খোলা পণ্যবাহী জাহাজে আসছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি হলে আমদানি-রফতানিতে আরো গতি আসবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম জানান, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে ধারণা করছি খোলা পণ্যের (কার্গো) ওপর ভর করে ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দিয়ে অর্থবছর শেষ হবে। এ চিত্র বিশ্বের অন্যান্য বন্দরের সঙ্গে তুলনা করলে উৎসাহব্যঞ্জক। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক বন্দরই শ্রমিক সংকটে অপারেশনাল কার্যক্রম ছোট করে এনেছিল কিংবা বন্ধই করে রাখতে হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে তেমন ধরনের কোনো সংকটই তৈরি হতে দেয়া হয়নি। বন্দর অপারেশনাল কার্যক্রম এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ ছিল না।