‘রোজিনার কান্না-বৃথা যেতে দেবো না...’ শ্লোগানে মুখরিত হয়েছিলো অনলাইন প্রেস ইউনিটির সমাবেশে সংবাদযোদ্ধাদের উচ্চারণে।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম ও সংবাদযোদ্ধারা রাজপথে-কাজপথে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ১৯২৩ সালের আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে কেবলমাত্র দেশ-মানুষের অধিকার হরণের রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার জন্য। নিপীড়িত হয়েছেন-নির্যাতিত হয়েছেন আবার মিথ্যে মামলারও শিকার হয়েছেন বরেণ্য সংবাদযোদ্ধা রোজিনা ইসলাম। টানা ৬ ঘন্টা আটকে রেখে নির্যাতন-নিষ্পেষন করার পর অসুস্থ্য হয়ে গেলেও হাসপাতালে না পাঠিয়ে পাঠানো হয়েছে শাহবাগ থানায়। সেই থানায় নেয়ার পর আরো ৪/৫ ঘন্টা কাটিয়ে ৩ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অপরাধ-দুর্নীতি করতে করতে বাংলাদেশে সচিব-আমলা-এমপি-মন্ত্রীদের জিহ্বা এত লম্বা হয়েছে যে, যখন তখন এরা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ফায়দা হাসিল করে জনগনকে কষ্ট দিচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম অবশ্য গণমাধ্যমকে ৫ সেকেন্ডের মধ্যে বলেছেন বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির রিপোর্ট করায় আমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রোজিনা ইসলাম বলেন, আমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করায় আমার সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। একথা বলার সাথেই তাকে সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় পুলিশ ‘কথা বলা যাবে না, কথা বলা যাবে না’ বলে তাকে সরিয়ে নেয়।
এখন প্রশ্ন হলো- কেন কথা বলা যাবে না? কি সমস্যা? কয়েকজন সংবাদযোদ্ধা এ প্রশ্ন করলে পুলিশ খারাপ ব্যবহার করেছে। সংবিধানের দেয়া আমাদের অধিকার আমরা বারবার লঙ্ঘণের জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে দেখেছি। এই অধিকার থেকে বঞ্চিত, নিপীড়িত রোজিনা ইসলামের রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেভাবে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে, সেভাবে বাংলা ভাইকেও কারাগারে পাঠানো হয়নি, নেয়া হয়নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় কতটা দুর্নীতি করেছে? তার উত্তর আমরা রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনগুলোতে উঠে আসতে দেখেছি। হয়তো অনেকের দুর্নীতি করতে বাঁধা দিয়েছে রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনগুলো। অনুসন্ধানী সেই প্রতিবেদনগুলোকে থামাতে সরকারের তথ্য চুরি ও ছবি তোলার অভিযোগে দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সোমবার মন্ত্রণালয়ে ৫ ঘণ্টা আটক রেখে রাতে পুলিশে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। পরে এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ওসমানীর স্বাক্ষর নিয়ে মামলা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে আটক রাখা অবস্থায় তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয় এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাও এই নির্যাতনে অংশ নেন। তেমনি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম রোজিনা ইসলামের গলা বার বার চেপে ধরছেন এবং তাকে শাসাচ্ছেন। আর ফেসবুক জুড়ে এই ঘটনার তীব্রনিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। একই সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, একজন সরকারি কর্মচারি হয়ে কিভাবে একজন মানুষের গলা চেপে ধরতে পারেন। তিনি কোথায় এতো সাহস পেল গায়ে হাত দেবার। তার বিচার চাই। এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজী জেবুন্নেসা বেগমের অবৈধ সম্পদের নানা খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ব্যাংকে নামে বেনামে প্রায় শত কোটি টাকার খবরও দিচ্ছে অনেকে। দুর্নীতিবাজ জেবুন্নেসা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রজেক্টে দুর্নীতি করেছেন মন্ত্রী-সচিব ও উপসচিবদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাদের সহায়তা নিয়ে। সেই দুর্নীতি করতে অন্যতম অন্তরায় ছিলেন নির্ভীক সংবাদযোদ্ধা রোজিনা ইসলাম এবং তাঁর প্রতিবেদনগুলো। আর সেই কারণেই ষড়যন্ত্র করে স্বাস্থ্য সচিবের পিএস সাইফুল ইসলামের রুমে ফাইল থেকে নথি সরানোর অভিযোগে রোজিনাকে পুলিশ দিয়ে ওই রুমে আটকে রাখা হয় এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরে তাকে শাসাচ্ছিলেন। এসময় তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর রাত পৌনে ১২ টার দিকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলার নম্বর ১৬, দন্ডবিধি ৩৯৭ এবং ৪১১ অফিসিয়াল সিক্রেসি এক্ট ১৯২৩ এর ৩/ ৫ এর ধারা মামলা করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী।
মামলার অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, সোমবার দুপুর ২.৫৫ মিনিটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তরে রোজিনা ইসলাম নামে একজন নারী প্রবেশ করেন। এসময় একান্ত সচিব দাপ্তরিক কাজে সচিবের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। উক্ত নারী দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পত্র শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকান এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলেন। এসময় সচিব দপ্তরের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মো. মিজানুর রহমান খান বিষয়টি দেখতে পান এবং বাধা দেন এবং তিনি নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে কক্ষে কি করছেন মর্মে জানতে চান। এসময় তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন। পরে অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম, উপ-সচিব জাকিয়া পারভিন, সিনিয়র সহকারী সচিব শারমিন সুলতানা, সচিবের একান্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞা, সিনিয়র সহকারী সচিব মোসাদ্দেক মেহেদী ইমাম, অফিস সহায়ক মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম, সোহরাব হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও স্টাফরা ঘটনাস্থলে আসেন। অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম তল্লাশি করে তার কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, ডকুমেন্টসের ছবিসহ মোবাইল উদ্ধার করেন। এতে প্রতিয়মান হয় যে, তিনি ডকুমেন্টসগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
কি এমন নথি? যে নথি বাংলাদেশে সাধারণ মানুষকে জানারও অধিকার দেয় না? তার মানে অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, জাতির ক্রান্তিকাল লোভি-লম্পটদের কারণে নির্মিত হচ্ছে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। তবে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা লোভি-লম্পটদের কারণে টিকা সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয়-সংগ্রহ সংক্রান্ত নেগোসিয়েশন চলমান রয়েছে এবং খসড়া সমঝতা স্মারক ও নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট প্রণয়নের কাজ চলছে। সমঝতা স্বাক্ষর নিয়ে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে প্রতিনিয়ত পত্র ও ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। এরই মধ্যে রোজিনা ইসলাম-এর সাহসী লেখনি থামাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী শাহবাগ থানায় তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ অভিযোগ দায়ের করেন। পরে অভিযোগটি মামলা আকারে নিয়েছে পুলিশ। সেখানে মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে বলা হয়েছে- বিকেলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের একান্ত সচিব এর দপ্তরে রোজিনা ইসলাম, পিতা-মৃত মুসলিম মিয়া, মাতা-তাসলিমা বেগম, স্বামী-সফিকুল ইসলাম, বাসা- ৯৭২, ৫ম তলা, থানা- শাহজাহানপুর, ঢাকা, মোবাইল নম্বর- ০১৭১২-১২০৫৫২ নামীয় একজন নারী প্রবেশ করেন। এসময় একান্ত সচিব দাপ্তরিক কাজে সচিব মহোদয়ের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। উক্ত নারী দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ-পত্র শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকান এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলেন। এ সময় সচিব মহোদয়ের দপ্তরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মিজানুর রহমান খান (কং নং ৩৩২৬১, সচিবালয়, ডিএমপি, ঢাকা) দেখতে পান এবং তাকে বাধা প্রদান করেন এবং তিনি নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে কক্ষে কি করছেন মর্মে জানতে চান।
অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, এ সময় তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় প্রদান করেন। পরবর্তীকালে অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম, উপসচিব জাকিয়া পারভীন, সিনিয়র সহকারী সচিব শারমীন সুলতানা, সচিবের একান্ত সচিব সাইফুল ইসলাম ভূঞা, সিনিয়র সহকারী সচিব মোসাদ্দেক মেহদী ইমাম, অফিস সহায়ক মাহফুজুল ইসলাম, সোহরাব হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও স্টাফগণ ঘটনাস্থলে আসেন এবং অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম তল্লাশি করে তার কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র এবং ডকুমেন্টসের ছবি সম্বলিত মোবাইল উদ্ধার করেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ডকুমেন্টসগুলো তিনি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে শাহবাগ থানার মহিলা পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে তাকে জিম্মায় নেন।
কেন পুলিশি জিম্মায় নিতে হবে ভাই? তিনি কি চোর? না তিনি চোর না। বরং তিনি নির্ভীক-সাহসীনী। সেই সাহসী নারী রোজিনার ভাই জনাব সেলিম বলেছেন, ‘সে (রোজিনা) বারবার বলেছে, আমি এমন কোনো অন্যায় করিনি, এমন কোনো অপরাধ করিনি, আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ অন্যায় করা হয়েছে, অপরাধ করা হয়েছে। আমি মানসিকভাবে বিপর্যন্ত। আমি আমার বন্ধুদের কাছে সাহায্য কামনা করছি। রোজিনা মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে। ও (রোজিনা) এ কথাটাই বলেছে, আমি প্রচন্ড রকম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। ও (রোজিনা) প্রচন্ড সাহসী একজন মেয়ে। কিন্তু সচিবালয়ের মধ্যে ওকে নির্যাতন করা হয়েছে। ওরে শুধু মারা হয় নাই, ওর বুকের ওপরে ওই অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এক মহিলা আছে পা চাপা দিয়ে ধরছে, গলা চাপ দিয়ে ধরছে। রোজিনা আমাকে এই কথাটি জিজ্ঞেস করছে যে, আমার সাংবাদিক বন্ধুরা কি আমার পাশে আছে? আমার বড় ভায়েরা কি আমার পাশে আছে? আমি বলছি, সব সাংবাদিক ভাইয়েরা আছে। ও বারবার সাহায্য কামনা করছে। আমার এই দুঃসময়ে আমার ভায়েরা, আমার বন্ধুরা যাতে আমার পাশে থাকে। ও বার বার এই কথাটাই বলছে।’
এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্মদাতা দুর্নীতিবাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালিক, মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া, তাঁর একান্ত সচিব (পিএস) মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞার (সিনিয়র সহকারী সচিব), কাজী জেবুন্নেসা, কামরুল প্রধান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী সহ এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচলিত আইনে বিচার এখন নাগরিকদাবি। এই দাবি বাস্তবায়ন না করলে আগামী দিনগুলো জাতির পিতার বক্তব্যনুযায়ী ৫% দুর্নীতিবাজের রামরাজত্বে পরিণত হবে বাংলাদেশ; যা আমাদের কারোই কাম্য নয়; কাম্য নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তৈরি হওয়া পতন।
যে পর্যন্ত না সংবাদযোদ্ধা রোজিনা ইসলামকে হামলা-মামলাকারীদের বিচার হবে; সে পর্যন্ত হয়তো আমাদের কানে ভাসতেই থাকবে-‘অতিরিক্ত সচিবকে খামচি দিয়েছেন, নথি ফাঁস হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়ে যেতো।’
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি