করোনা বা কোভিড-১৯ একটি সাধারণ নামে পরিণত হয়েছে। ছোট থেকে বড়, স্বাক্ষর থেকে নিরক্ষর সকলের কাছেই পরিচিত নাম। তবে পৃথিবীতে সব নামই বিখ্যাত হয় না কুখ্যাত নামও কিছু থাকে। করোনা বা কোভিড-১৯ তেমনই একটি কুখ্যাত মহাবিপর্যয়ের নাম। এর প্রভাবে গোটা বিশ্বই আজ বিপর্যস্থ। রুটি-রুজি নেই। মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু নির্মম পরিহাস, মৃত্যুর মিছিল যেন দীর্ঘই হচ্ছে।
বাংলাদেশ করোনার প্রথম ঢেউ প্রতিরোধ করতে সফল হয়েছে। ফলে দীর্ঘ হয়নি মৃত্যুর মিছিল আক্রান্তও ছিল তুলনামূলক সুবিধাজনক স্থানে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ও সনাক্তের হার সুখকর নয়। বর্তমানে কমতে শুরু করলেও করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আভাস মিলছে। উড়িয়ে দেওয়া যায় না তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা। বিশেষ করে পাশ্ববর্তীদেশ ভারতের সনাক্ত বিবেচনায় ও ভারতের সাথে যোগাযোগের সূত্রে তৃতীয় ঢেউ আসবে এমনটাই মত অনেকের।
বাংলাদেশেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) শনাক্ত হয়েছে। ৮ মে শনিবার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইডিসিআর) এ তথ্য জানিয়েছে। আইডিসিআর জানায়, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের একটি নমুনা পরীক্ষায় এ ভারতীয় স্টেইন ধরা পড়েছে। যা জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটাতে (জিএসআইডি) প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ভারতে প্রথম শনাক্ত ‘বি.১.১৬৭’ নামে করোনার ধরনটি বিশ্বের এক ডজনের বেশি দেশে পাওয়া গেছে। এমন দেশের সংখ্যা কমপক্ষে ১৭টির বেশি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সময়মতো সরকার লকডাউন ঘোষণা করায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হয়তো সামনেই কমে যাবে। তবে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এর কারণ সম্পর্কে সচেতন না হলে সামনে আবার করোনার তৃতীয় ঢেউ চলে আসবে এবং তৃতীয় ঢেউ আরো ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে। একারণে করোনার হাত থেকে বাঁচতে চাইলে, দেশের প্রতিটি মানুষকে করোনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে বলেও জানান মন্ত্রী। যা কিছু ভাল তা সকলের জন্যই প্রযোজ্য। জাহিদ মালিকের অনেক বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত। তাই জাহিদ মালিকের বক্তব্য আমারও বক্তব্য। করোনাকে বিদায় জানাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। কারণ করোনার কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে পরেছে। সচেতন না হলে তা আগামীর জন্য আরও ভয়াবহ হবে। কারণ আমরা ভারতের প্রতিবেদনগুলো নিশ্চই দেখছি।
প্রতিবেশী ভারতের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে, সেখানে আক্রান্ত প্রতি ৪ জনের এক জনই মারা যাচ্ছে। সৎকারে শ্মশানে কোনো জায়গা নেই। মাঠে-ময়দানে পোড়ানো হচ্ছে সারি সারি লাশ আর লাশ। সে কী হূদয় বিদায়ক এক অবস্থা! কখন বন্ধ হবে মৃত্যুর এ মিছিল তাও অজানা আজ সবার কাছে। সবার চোখে-মুখে এক অজানা আতঙ্ক। মৃত্যুদূত কখন যেন কাকে টেনে নিয়ে যায় শ্মশানে, যদিও এ প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে কম। মহারাষ্ট্রের অবস্থা সবচেয়ে করুণ! হাসপাতালে শয্যা নেই, অক্সিজেন নেই, অ্যাম্বুলেন্সের অভাব, এক মানবিক মহাবিপর্যয়! শুধু ভারতেই কি আজ এই মহাবিপর্যয়? না, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অবস্থাও করুণ! উন্নত সেসব দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে লকডাউন, এমনকি কারফিউ পর্যন্ত। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সব বন্ধ। আজ জীবিকা নয়, জীবনই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে সকলের প্রার্থনা মাতৃভূমি যেন এমন বিপদের কবলে না পরে।
করোনার ভারতীয় ধরনকে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সংস্থাটির কভিড ১৯ বিষয়ক প্রধান মারিয়া ভান কেরখোভ এ কথা বলেছেন। গত বছরের অক্টোবরে ভারতে প্রথমবারের মতো করোনার বি.১.৬১৭ ধরনটি শনাক্ত হয়। করোনার এ ধরন অতি সংক্রামক। দ্রুত একজনের কাছ থেকে অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মূলত এ ধরনের কারণে ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে পুরো ভারত। রাশিয়ায় করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির এক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা। মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে আট হাজার ২৭৭, এর মধ্যে মস্কোতেই এক হাজার ২৯১ জন। একইসময়ে মারা গেছেন ৪০৯ জন। রাশিয়ায় ডিসেম্বর মাসে গণ টিকাদান শুরু করেছিল। পুতিন গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে প্রায় ৪৩ লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের দুই ডোজই পেয়েছে। মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়াতে ৪৫ লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। সুতরাং রাশিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সচেতনতার উপর জোর দিতে হবে।
রোববার (১৬ মে) স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ জনে। একই সময়ে নমুনা পরীক্ষায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরও ৩৬৩ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৮০ হাজার ১৫৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, রোববার (১৬ মে) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন আরও প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এখন পর্যন্ত বিশ্বে মোট করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ২৩০ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ কোটি ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৭৩ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৪ কোটি ১৪ লাখ ৬২ হাজার ১৪৬ জন। আক্রান্তের দিক থেকে প্রথম যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় ভারত, তৃতীয় ব্রাজিল, চতুর্থ ফ্রান্স, পঞ্চম স্থানে রয়েছে তুরস্ক। রাশিয়া ষষ্ঠ, যুক্তরাজ্য সপ্তম, ইতালি অষ্টম, স্পেন নবম এবং জার্মানি দশম স্থানে রয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম।
যদিও রোববার (১৬ মে) দুপুরে চলমান বিধিনিষেধ আগামী ২৩ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে বলা হয়, বর্তমান করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের সব বিধিনিষেধ ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় নতুন কিছু শর্তে ১৬ মে মধ্যরাত থেকে ২৩ মে মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধ বাড়ানো হলো। নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, চলমান বিধিনিষেধের সময় সরকারের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব দফতর, জরুরি পরিষেবা আওতাভুক্ত থাকবে এবং খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁ কেবল খাবার বিক্রয় ও সরবরাহ করতে পারবে। চলমান বিধিনিষেধে সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্যাংকের কার্যক্রমও ২৩ মে পর্যন্ত সীমিত পরিসরে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কোন বিধি-নিষেধই কার্যকর হবে না যদি জনগণ সচেতন না হয়। কারণ দেখেছি আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস চালুর সময় ঢাকা থেকে রংপুর যেতেও বাধা থাকেনি। হয়ত গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে। কিন্তু একই ব্যক্তি একাধিক গণপরিবহনে পদচারণা করোনার ঝুঁকি কমিয়েছে না বাড়িয়েছে তা কিন্তু ভেবে দেখা দরকার। তাই বিধি-নিষেধের সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর করা দরকার। দরকার জনসাধারণের সদিচ্ছা। করোনার তৃতীয় ঢেউ খুবই মারাত্বক সেই বিবেচনায় তৃতীয় ঢেউকে রুখে দিতে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। করোনাকে জয় করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
বিপদকে সুযোগ দেওয়া কোন কালে কোন ব্যক্তির জন্যই সঠিক নয়। তাই করোনার মত এই কুখ্যাত ভাইরাসটিকে আর সুযোগ নয়। পৃথিবীতে মানুষ পারে এমন কোন কাজ নেই। কারণ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আসুন আরও একবার সচেতনতার জোয়ার তুলি। একটু সচেতনতা মুক্ত রাখবে ভয়াবহ করোনা থেকে। সচেতন রাখতে সরকার ও জনসাধারণকে সমন্বিত ভ’মিকা রাখতে হবে। করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, নিয়মিত সঠিকভাবে মাস্ক পরি, সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করি। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতাকে রুখে দেই। বিষাক্ত বাতাস পরিহার করি। নির্মল বায়ুর শ্বাস নেই। করোনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট