দিন দিন ই-বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য বর্জ্যরে তুলনায় ই-বর্জ্য দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ই-বর্জ্য মাটির সঙ্গে মিশে উর্বরতা ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। দেশে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহারও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। আর ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি দেশজুড়ে অব্যবহৃত বা অকেজো পণ্যের পরিমাণও বাড়ছে। অথচ ওসব বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ বা ধ্বংসে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় পরিবেশের জন্য তা ভয়াবহ হুমকির কারণ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে এখনই নীতিমালা-আইন করার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স বর্জ্যরে (ই-বর্জ্য) লাগাম টানা জরুরি। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক মেশিনারি মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএমএমএ) গবেষণার তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন টন ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহ হয়। তার মধ্যে মাত্র ২০-৩০ শতাংশ পণ্য রিসাইক্লিং বা ধ্বংস হচ্ছে। অথচ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতি বছর দেশের মোটা অঙ্কের মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেজন্য সরকারি সহযোগিতা ও জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। আর বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) গবেষণার তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ১২ লাখ টনে উন্নীত হবে। ওসব বর্জ্য রিসাইক্লিং করতে গিয়ে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ শিশু মৃত্যুবরণ করছে এবং ৮৩ শতাংশ স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এমন অবস্থায় ই-বর্জ্যরে ক্ষতির প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে জরুরিভিত্তিতে নীতিমালার প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সূত্র জানায়, বর্তমানে হকাররা মাইক বাজিয়ে ভ্যানগাড়িতে করে শহর কিংবা গ্রামে প্রতিনিয়ত অব্যবহৃত-অকেজো প্রযুক্তি পণ্য সংগ্রহ করেন। তার মধ্য থেকে কিছু পণ্য মেরামত করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে বিক্রি করা হয়। আর কিছু পণ্য রিসাইক্লিং করা হয়ে থাকে। কিন্তু তার বাইরেও বড় অংশজুড়ে প্রযুক্তি পণ্য মাটির সঙ্গে মিশে উর্বরতা ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। দৈনন্দিন ব্যবহৃত পণ্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক বাতি এবং বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক খেলনা থেকে সবচেয়ে বেশি বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ওসব বর্জ্যে রয়েছে সিসা, পারদ, লিড অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম জাতীয় ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান। যা মানুষের ত্বক, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্রসহ বিভিন্ন ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০ বছর ধরে ই-বর্জ্যরে একটি নীতিমালা প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এমন ধরনের একটি নীতিমালার (ডিসপোজাল ম্যানেজমেন্ট রুল) খসড়া পরিবেশ অধিদফতরে পড়ে রয়েছে। অথচ দেশের বাজারে ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানিতে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে ওসব নীতিমালার অভাবে মার্কেটে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। বাইরে থেকে দেশে কোন পণ্য আসবে বা আসবে না তা নীতিমালায় পরিষ্কার করে তুলে ধরা জরুরি। সেজন্য সরকারকে যতো দ্রুত সম্ভব ই-বর্জ্যরে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় দেশ এক সময় প্রযুক্তি পণ্যের ভাগাড়ে পরিণত হবে।
এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভয়ানক ক্ষতিকর হবে বলে মনে করেন। তিনি জানান, দেশে জ্যামিতিক হারে মোবাইলফোনসহ অন্যান্য প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে ওসব থেকে বিপুল সংখ্যক ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। দেশে সাধারণ ও মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ই-বর্জ্য ধ্বংস বা সংগ্রহের জন্য কোনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ অন্যান্য বর্জ্যরে তুলনায় ই-বর্জ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অস্ট্রেলিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাদের মতো করে এদেশের মানুষকেও সচেতন করার মাধ্যমে এবং ইনসেপ্টিভ দেয়ার মাধ্যমে—অর্থাৎ বর্জ্য সঠিক স্থানে ফেলার বিনিময়ে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও পরিবেশের সংঙ্গে যুক্ত সরকারের সকল স্তরকে এগিয়ে আসতে হবে।
অন্যদিকে ই-বর্জ্যরে নীতিমালা প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানান, ভেটিংসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে নীতিমালার খসড়াটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। খুব শিগগিরই খসড়াটি বিজি প্রেসে ছাপানোর জন্য পাঠানো হবে।