জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবে হুমকির মুখে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত চিংড়ি শিল্প। ওই কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিংড়ি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতি বছরই কমছে চিংড়ি উৎপাদন। বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে চিংড়ি উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার ৮৫৫ টন। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৪৭ হাজার ৩০৪ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে ৭ হাজার ৪৪৯ টন। গত এক দশকে দেশে ২০১১-১২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। যার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫২ হাজার ৫২৩ টন। কিন্তু বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির লবণাক্ততার তারতম্য, চিংড়ি ঘেরের গভীরতা হ্রাস, মানসম্মত পোনার অভাব, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের অপর্যাপ্ততা, মাটি ও পানির শক্তি হ্রাসের কারণে চিংড়ি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করার প্রতিটি নিয়ামক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সঙ্গে জড়িত। মৎস্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের চিংড়ি উৎপাদনের উর্বরভূমি হিসেবে ৪টি জেলাকে বিবেচনা করা হয়। ওই জেলাগুলো হচ্ছে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার। ওসব জেলার চাষীরা রফতানিযোগ্য বাগদা ও গলদা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে। তবে গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ পদ্ধতির ভিন্নতা রয়েছে। গলদা স্বাদু পানির মাছ হলেও কম লবণাক্ত পানিতেও চাষ করা যায়। আর বাগদা চিংড়ি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন লবণাক্ত পানি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছরে দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে চিংড়ি ঘেরগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির কারণে ঘেরের পানির লবণাক্ততার তারতম্য ঘটছে। তাছাড়া হঠাৎ অতিরিক্ত গরম ও ঠা-ার কারণেও দুর্বল হয়ে পড়ছে চিংড়ি। ফলে কখনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দেখা দিলে চিংড়িগুলো সহজেই আক্রান্ত হয়। অনেক সময় ওই মড়ক এক ঘের থেকে অন্য ঘেরে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া এখন ভালো মানের পোনাও পাওয়া যায় না। কারণ পোনার প্রধান উৎস নদী। পানিপ্রবাহের মাত্রা কমে যাওয়ায় নদী থেকে যথাযথ পরিমাণে পোনা আহরণ করা যায় না। তাছাড়া হ্যাচারি থেকে যেসব পোনা পাওয়া যায় তার গুণগত মান সব সময় এক রকম থাকে না।
সূত্র জানায়, আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাগেরহাটে গড়ে উঠেছে চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র। চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয় ও প্রতিকার এবং চিংড়িজাত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ওই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ায় এদেশেও ঋতু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে চিংড়ি মাছের ঘেরের পানি অতিরিক্ত গরম হচ্ছে। তাছাড়া পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ও প্রচ- গরমে চিংড়ি লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। আবার কখনো রাতে হঠাৎ বৃষ্টির কারণে বা হঠাৎ ঠা-ার কারণেও চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে চিংড়ি একদিনে রোগাক্রান্ত হয় না। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ফ্যাক্টর রয়েছে। যেমন তাপমাত্রা, স্যালাইন ডিফল্ট করা, মাটির পিএইচ, অক্সিজেন ইত্যাদি। যার কারণে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় পাইকগাছায় লোনা পানি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানটিতে কৃত্রিম উপায়ে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের উন্নততর কলাকৌশল উদ্ভাবন, চিংড়িচাষীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বাগদা চিংড়ির প্রাকৃতিক উৎস নিরূপণ এবং উপকূলীয় পরিবেশসহ চিংড়ির পোনা সংগ্রহকালে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়াসহ নানাবিধ বিষয়ে গবেষণা হয়। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিংড়ি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী ভরাট হয়েছে। নদীর ¯্রােত কমে যাচ্ছে। তাতে পানির লবণাক্ততার পরিমাণে উত্থান-পতন হচ্ছে। তাছাড়া খরা বা অসময়ে বৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টিও চিংড়িসহ যে কোনো ফসলের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া অনেক চিংড়ি ঘেরেরই পানির গভীরতা কমে গেছে। পলির স্তর পড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঘেরে মাত্র এক-দুই হাত বা এক ফুট উচ্চতার পানি থাকে। তাতে চৈত্র মাসে পানির নিচের মাটি পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আর এভাবে ধীরে ধীরে রোগাক্রান্ত হতে হতে ঘেরে মড়ক লাগে। তাছাড়া নদীর দূষণও একটি বড় বিষয়। নদীর পানির মাধ্যমে দূষিত পদার্থ চিংড়ি ঘেরে ঢুকে যাচ্ছে। তাতেও চিংড়ির ক্ষতি হচ্ছে। তবে সেজন্য এককভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যাবে না। চিংড়ি উৎপাদন কমার আরো কিছু কারণ আছে। যেমন- এদেশে চিংড়ি চাষ পদ্ধতির উন্নতি হয়নি। বেশ লম্বা সময় ধরে এদেশে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো বিজ্ঞানভিত্তিক চাষের দিকে না এগিয়ে সনাতন পদ্ধতিকেই বেছে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী শামস্ আফরোজ জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিংড়ি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানি শুকিয়ে যাওয়া, ঘেরের নাব্যতা কমার মতো ঘটনা ঘটে। তাতে চিংড়ি উৎপাদন কমে যেতে পারে। তবে উৎপাদন কমার আরো কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে চিংড়ি চাষের জমি কমে যাওয়া, চাষীদের অনেকেরই চিংড়ি চাষের পরিবর্তে কাঁকড়া বা অন্যান্য ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে যাওয়া। ওসব কারণেও চিংড়ি উৎপাদন তুলনামূলক কমেছে।