প্রথম আলোর সিনিয়র প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম সাংবাদিকতায় শত বছরের পুরোনো আইন মাড়িয়ে ফিরে এলেন চার দেওয়ালবন্ধী জীবন থেকে মুক্ত বাতাসে।
গত ২৩ মে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হন। এর আগে ওইদিন সকালে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনে করা মামলায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন ভার্চুয়াল আদালত।
বিচারক রোজিনার জামিন আদেশে বলেন, ‘পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় তার অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হলো। এ ছাড়া তাকে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।’
গত ১৭ মে বিকেলে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। ওইদিন তাকে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে রাত সাড়ে ৮টার দিকে সচিবালয় থেকে পুলিশি পাহারায় শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলার নম্বর ১৬। দ-বিধি ৩৯৭ এবং ৪১১ অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩ এর ৩/৫ এর ধারায় এ মামলা করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কণ্ঠরোধ শিরোনামের প্রবন্ধে বলছেন, ‘একদিন দেখিলাম, গবর্মেণ্ট্ অত্যন্ত সচকিতভাবে তাঁহার পুরাতন দ-শালা হইতে কতকগুলি অব্যবহৃত কঠিন নিয়মের প্রবল লৌহশৃঙ্খল টানিয়া বাহির করিয়া তাহার মরিচা সাফ করিতে বসিয়াছেন। প্রত্যহ-প্রচলিত আইনের মোটা কাছিতেও আমাদিগকে আর বাঁধিয়া রাখিতে পারে নাÑআমরা অত্যন্ত ভয়ংকর!’
সিডিশন বিল পাস হওয়ার আগে ১৮৯৮ সালে একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কণ্ঠরোধ প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে ভারতবর্ষে জারি হয়েছিল সরকারি গোপনীয়তার কুখ্যাত আইন ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ (সিডিশন বিল)। নতুন করে একশত বছর পর ওই আইন আবারও আলোচনায় এল এগিয়ে যাওয়ার ডিজিটালের এ বাংলাদেশে। গত ১৭ মে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয় এ আইনেই।
শত বছরের পুরোনো আইন :
হঠাৎ শত বছরের পুরোনো আইনকে কেনে টেনে আনা হলো? আইনটিতে কী আছে? আইনের প্রেক্ষাপট কী, এর প্রয়োগ কোথায় কোথায়? এসব নানাবিধ প্রশ্নের জবাব খোঁজতে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা যা, এই আইনের জনক বলুন বা জননী ‘কুইন্স সিক্রেটস অব দ্য রিলম’। রানি প্রথম এলিজাবেথের সময় ফ্রান্সিস ড্রেকের নেতৃত্বে পাঁচটি জাহাজের একটি বহর সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিল। নাম যদিও ছিল ভয়েস অব ডিসকভারি, আদতে উদ্দেশ্য ছিল সাগরে স্পেনের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা। ১৫৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫৮০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা ওই অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছিল।
বলা হয়েছিল, অভিযানের কোনো তথ্য তাঁরা মরে গেলেও ফাঁস করতে পারবেন না। যে নির্দেশের অধীনে তাঁরা এই অঙ্গীকার করেছিলেন, সেটাই কুইন্স সিক্রেটস অব দ্য রিলম। তবে এখানেই থেমে থাকেনি ইংরেজরা। ভিন্ন ভিন্ন নামে ও চেহারায় তথ্য গোপনের সংস্কৃতির যে চর্চা, সেটা চালিয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও সংস্কার হলেও তবে ভালো কিছু হয়নি।
গোপনীয়তা একটি বিশেষ রোগ:
ব্রিটিশদের এই গোপনীয়তার সংস্কৃতি নিয়ে একটা গোটা বই লিখে ফেলেছেন ক্রিস্টোফার মোরান। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটির নাম 'ক্ল্যাসিফায়েড: সিক্রেসি অ্যান্ড দ্য স্টেট ইন মডার্ন ব্রিটেন'। বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে ডায়ানা ক্লার্ক গিল লেবার পার্টির এক সাংসদের কথা বলেছেন। ওই সাংসদ বলেছিলেন, গোপনীয়তা ইংরেজদের একটা বিশেষ রোগ এবং ব্রিটিশ সরকারের একটা অনিরাময়যোগ্য জটিল অসুস্থ্যতার নাম।
খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জানা যাচ্ছে, এই রোগে ভুগছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের ৪০টির মতো দেশ। এই দেশগুলোর বেশির ভাগই আবার ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল।
ক্ল্যাসিফায়েড: সিক্রেসি অ্যান্ড দ্য স্টেট ইন মডার্ন ব্রিটেন :
১৮৮৯ সালে প্রথম অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট হয়েছিল। যথেষ্ট শক্ত নয় বলে দুই দশকের মধ্যেই আবার ওই আইনের পরিবর্তন হয়। ১৯১১ সালে যে আইনটি আসে, তা আরও কঠিন, ব্যাপ্তিও অনেক। এই আইনে একজন কলমিস্ত্রি কোনো অফিসের বাথরুম ফিটিংস নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলুক কিংবা ব্রিটিশ নেভির রণকৌশল কেউ নাৎসিদের কাছে ফাঁস করুকÑদুটোই অপরাধ বলে গণ্য হতো। ব্রিটেনের সরকারি কর্মচারী, আমলারা জানে বাঁচতে সে সময় প্রাণপণে গোপনীয়তার চর্চা করতেন। তবে সংবাদপত্র এই আইনের আওতামুক্ত ছিলেন। তাঁদের জন্য অন্য একটা কৌশল নিয়েছিল সে দেশের সরকার, যাকে বলা হয় ‘ডি’ নোটিশ।
সিক্রেটস আইনের ভারত ভ্রমণ:
১৮৯৯ সালে ভারতবর্ষে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট জারি হয়। ভারতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান রাফাল নিয়ে দর-কষাকষি করছেÑএই খবর প্রকাশের পর দ্য হিন্দুকে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল কে. কে. ভেনুগোপাল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩-এর ভয় দেখিয়েছিলেন দ্য হিন্দুর পাবলিশিং গ্রুপের চেয়ারম্যান এন রামকে। তাঁর নামেই ছাপা হয়েছিল প্রতিবেদনটি। ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপার পাশাপাশি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ভারতবর্ষে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে, ভারতবর্ষে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৮৯৯ জারি থাকার পরও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষায় খবরের কাগজ ছাপা হচ্ছিল। সরকারি নীতির সমালোচনা ছাপা হচ্ছিল দেদার, উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো। তাদের ঠেকাতে ভারতবর্ষে পুরোনো আইনের সংযোজন-বিয়োজন করে ইন্ডিয়ান অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯০৪ জারি হয়। এর জেরে সে সময় সংবাদপত্র প্রকাশকেরা পুলিশি নির্যাতন, জেল-জুলুমের শিকার হন। ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবশ্য বলছে, আইনটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদী প্রকাশনীর কণ্ঠ রোধ করা।
আইন করে মুখবন্ধ:
আসলে কি কঠোর কঠিন আইন দিয়ে মুখবন্ধ রাখা যায়? রাখলে কত দিন? ক্রিস্টোফার মোরানের বইয়ের আলোচনায় যদি ফিরে যাই, তাহলে বলতে হবে, যায় না। কারণ, ব্রিটেনে সরকারি অফিসের কর্মচারী থেকে আমলা পর্যন্ত সবাই মুখ বন্ধ করে রাখলেও বিশ শতকে এসে দেখা গেল, স্মৃতিকথার নামে উইনস্টন চার্চিল পর্যন্ত অনেক গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন। পত্রিকাগুলোর জন্য ডি নোটিশ জারি রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। এই ব্যবস্থায় সরকার কোনো জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিশেষ কোনো প্রতিবেদন না ছাপার অনুরোধ করতে পারত। সেই ব্যবস্থাও টেকেনি।
১৯৬৭ সালে চ্যাপম্যান পিনচার নামের এক সাংবাদিক খবর ছেপে দেন যে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষের ফোনে আড়ি পাতে, টেলিগ্রাম পর্যন্ত খুলে পড়ে দেখে। বিপর্যস্ত প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন বলেন, তিনি দু-দুবার ডি নোটিশ দিয়েছেন, তা-ও পত্রিকা কথা শোনেনি। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত প্রিভি কাউন্সিলে গড়ায়। তাঁরাও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের পক্ষে দাঁড়ান। আর ২০১৩ সালে তো স্নোডেনের ফাঁস করা নথি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশই করে দ্য গার্ডিয়ান।
হঠাৎ কেনো প্রয়োগ :
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রয়োগের কোনো খবর দিতে পারেনি জনগণের তথ্য অধিকার ও সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা দুটি সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন বা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই)। তবে পাশের দেশ ভারতে ইদানীং আবারও এই আইনের কয়েকটি প্রয়োগ দেখা গেছে।
২০১৮ সালে এই আইনে দোষী সাব্যস্ত হন সাবেক কূটনীতিক মাধুরী গুপ্তা। তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে তথ্য পাচারের অভিযোগ আছে। সাংবাদিকদের মধ্যে ২০১৭ সালে পুনম আগারওয়ালকে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। কাশ্মীর টাইমস-এর সাংবাদিক ইফতিকার গিলানির বিরুদ্ধে উপত্যকায় সেনার অবস্থান-সম্পর্কিত নথি রাখার দায়ে ২০০২ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে মামলা পরে সরকারকে তুলে নিতে হয়।
আর দ্য হিন্দুর পাবলিশিং গ্রুপের চেয়ারম্যান এন রামকে যখন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের হুমকি দিলেন, তিনি পাত্তাই দেননি, বলেছেন, নথি তিনি চুরি করেননি, টাকা দিয়েও কেনেননি। উল্টো কঠোর ভাষায় ঔপনিবেশিক আমলের এই আইনের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যা প্রকাশ করেছি, তা সম্পূর্ণ যথাযথ এবং জনস্বার্থে প্রকাশিত।’ সুতরাং সেখানে এই আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে খুব কাজে আসেনি।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫২। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালুর পর থেকে লাফিয়ে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। বর্তমানেই তিনজন সাংবাদিক এই আইনের শিকার হয়ে জেলে। নিকট অতীতে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের খবর নেই। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে দিয়ে এখানেও শুরু হলো।
আশার খবর হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো প্রয়োগ হলেও শত বছরের পুরনো ওই আইন মাড়িয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম আদালতের জামিন লাভের মাধ্যমে বন্ধিজীবনের অবসান হলো। ফলশ্রুতিতে আমারও রোজিনা আপার মুক্তিতে কারাপ্রকষ্ঠে যাওয়া হলো না! তার মানে হচ্ছে, 'আমার জেলহাজতের বিনিময়ে রোজিনা ইসলামের মুক্তির নিবেদন' শিরোনামে গণমাধ্যমে নিবন্ধন লিখেছি। শেষাবধি জামিন মঞ্জুর হওয়ায় রোজিনা আপার মুক্তির ইস্যূতে চারদশকের জীবনের দুইদশকের সাংবাদিকতায় পঞ্চম বারের মতো আমাকেও টানতে হলো না নিদারুণ যাতনার কারাপ্রকষ্ঠের আবদ্ধ জীবনের ঘ্লানি!
(এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহসম্পাদক)