কে কখন কীভাবে পৃথিবীর মোহ-মায়া ছেড়ে না ফেরা জগতে পাড়ি দিবে, তা জানবার কথা নয়। এ কারণেই পৃথিবীতে নতুন কোনো অতিথির আগমনের খবর চাউর হলেও পৃথিবী থেকে কখন কাকে প্রস্থান হতে হয়, এটা গবেষণার বিষয় না হলেও কারো কারো পৃথিবী ত্যাগ করার ঘটনা হৃদয়ে রক্তক্ষরণের রূপ নেয়। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় না থাকলেও মাত্র আড়াই দশকের জীবনে অসময়ে ঝরে যাবে আমার অদেখা বকুল, এমনটি কখনো ভাবিনি। এমন কি'বা অশুভ কাজের দায়ে বকুলকে না ফেরা জগতে পাড়ি জমাতে হলো অসময়ে? অথবা কি এমন বয়স হয়েছিল বকুলের? যে বয়সের ভারে অবেলায় বকুলের প্রাণপাখি অচেনা দেশে পাড়ি দিতে হলো। এমন নানাবিধ প্রশ্নের জবাব খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় ২৮ মে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের আলো-বাতাস শরীরে মাড়িয়ে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার ভালোবাসার মানসী অদেখা বকুলের ফসল দুটো মেয়ে। বড়ো মেয়ের নাম অর্পিতা। ওর বয়স বড়ো জোর পাঁচ বছর। দেড় বছর বয়সী ছোটো মেয়ে অনু। গুরুতর আহত হয়ে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনন্ত কুমার। তিনি বকুলের গর্ভের ফসল বুচি মা দুটোর বাবা। তাদের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার হাসেমপুরে। বকুলকে আমি জানতাম বিউটি রায় নামে। কর্মজীবনে বিউটি-অনন্ত দম্পত্তি তিন-চার বছর থেকে মির্জাপুরের বাসিন্দা। অনন্ত কুমার এইচবি বারডেম ফারমাসিউটিক্যালে এমপিও পদে মির্জাপুর এরিয়ায় কর্মরত। বিউটি রায় একই এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকুরি করতেন। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ আয়-রোজগারে ভালোই চলছিল ওদের সংসার।
গত ২ মে থেকে কুমুদিনী হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অনন্ত কুমার। ওইদিন ভোর ছয়টায় কর্মস্থলে নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে স্ত্রী বিউটি রায়কে পৌঁছে দিচ্ছিলেন অনন্ত কুমার। এমন সময় পেছন থেকে ঘাতক গাড়ি তাদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলে বিউটি রায়ের প্রাণপ্রদ্বীপ নিভে যায়। গুরুতর আহত হয়ে সেই থেকে ভাগ্যবিডম্বনা অনন্ত কুমার ভালোবেসে পাওয়া জীবন সঙ্গীনি বিউটি রায়কে চিরতরে হারিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালে। মা মরা মেয়ে দুটো এবং আমার অদেখা মানসী বিউটি রায়ের স্বামী অনন্ত কুমারকে দেখতেই সেদিন মির্জাপুরে যাওয়া।
টানা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেবলমাত্র তিন গ্লাস জল পানে ক্ষুধার যন্ত্রণা প্রতিরোধের মিছামিছি চেষ্টা করে শান্ত হলাম সেদিন। সময়ের কাজ সময়ে না করায় নিজের প্রতি বিচারের অংশ হিসেবে পেটপাড়ায় অন্নের অনশন পদক্ষেপ। কারণ, একযুগ আগে সাংবাদিকতার সুবাদে মোবাইল ফোনে আলাপচারিতায় বিউটি রায়ের সাথে পরিচয়। সেই থেকেই বিউটি রায় আমার অদেখা বন্ধু। ধীরে ধীরে তা গভীর মায়ারবন্ধনে রূপ নেয়। আমরা উভয় উভয়কে 'আপনি' বলে সম্বোধন করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। একাধিকবার প্রস্তুতি নিয়েও আমাদের একে অপরের সাথে দেখা হয়নি। গত রমজানের ঈদে আমার বাড়িতে বিউটি রায়ের নিমন্ত্রণ ছিল। কথাও পাকাপাকি হয়েছিল। স্বামী-সন্তানসহ আমার বাড়ি আসবেন বিউটি রায়। কিন্তু শেষাবধি তা, আর হয়নি। বিউটি রায়কে পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে পাড়ি দিতে হয়েছে না ফেরা জগতে। বিউটি রায়ের রেখে যাওয়া অবুঝ মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে কুলে নিলে, চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলাম না। অঝরধারায় গাল মাড়িয়ে বাঁধভাঙ্গা অশ্রুজল ঝরতে ছিল। আমার-বিউটি রায়ের বন্ধুত্বের কথা আগে থেকে জানতেন বিউটি রায়ের স্বামী অনন্ত কুমার। কুমুদিনী হাসপাতালের বিছানায় সেই স্মৃতি স্মৃতিচারণ করতে না করতেই অনন্ত কুমার কান্নায় ভেঙে পড়লে চোখের জলে ভিজতে আমারও সময় লাগেনি। রোল পড়ে কান্নার। আমাদের বিলাপে হাসপাতালের পরিবেশ মুহুর্তেই ভারি হয়ে উঠে। নিমিষেই হারিয়ে যাই স্মৃতির বাতায়নে।
আমাকে কতবার যে বিউটি রায় তাদের বাড়িতে যেতে নিমন্ত্রণ দিয়েছিল, ওই হিসাবের ইয়েত্তা নেই। একযুগে কত শতবার ফোনে অসংসার-সংসার জীবনের কথা হয়েছে, এ হিসাব বড়ই জটিল। সুখ-দুখের আলাপচারিতা কত কথাই না মনে নাড়া দেয়। আমাকে প্রথম টানা দুই বছর ফোনে কথা বলার প্ররাম্ভে 'নমষ্কার' দেওয়ার পর থেকে 'আসসালামু আলাইকুম' বিনিময়ে তটস্থ হওয়ার কতই না ধূসর-স্মৃতি বিউটি রায়কে ঘিরে। আমি ইসলাম ধর্মের একথা জানানোর পরও হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও বিউটি রায় আর আমার মাঝে সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ছেঁদ ধরেনি। মোবাইলফোনে কথা বলার শুরুতে একদম বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম জানাত। নামাজ পড়েছি কি-না, সেটাও জেনে নিতো। চোখের জলে নিজের প্রতি ধিক্কার জানাই, আগে কেনো বিউটি রায়ের সাথে দেখা করিনি। এখন কেঁদে কেঁদে বুকভাসিয়ে লাভ কী?
কবিতার পঙক্তিতে বলতে হয়-
বিউটিকে পাবো না, এও আমি ভালো করে জানি;
তবু কেনো ও'কথাটিতে চোখে আসে পানি?
চোখের জলে ভাসি আজ চোখের জলে খোঁজি;
চোখের জলে ভিজে আজ কেনো কাঙাল সাজি।
আশার কথা হচ্ছে, বিউটি রায়ের রেখে যাওয়া স্বজনদের খোঁজ খবর নিতে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে সমদুঃখীর ভাগিদার হয়েছে আমার স্কুল শিক্ষিকা গিন্নি। মির্জাপুর যাওয়ার কথা শোনে আগের দিনই ব্যাকং থেকে গিন্নির বেতনের টাকা উত্তোলন করে আমাকে বুঝিয়ে দিতে তার ছিল অবিরাম প্রচেষ্টা।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
‘সুখ-সুখ’ করি কেঁদো না আর;
যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
কালজয়ী কবি কামিনী রায়ের উপর্যুক্ত কবিতাটি পাঠ্যবইয়ে স্কুলজীবনে মুখস্থ করলেও বাস্তব জীবনে ক'জনইবা হদয়ে ধারণ করি। আমার নিজেরও কবিতাটি বাস্তব জীবনে রূপ দিতে ভূমিধ্বস পরাজয় অদৃশ্য নয়। যেকারণে একযুগেও বিউটি রায়ের সাথে আমি দেখা করতে পারিনি। কবিতারটি বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে ভুল করেনি লালমনিহাটের বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী যুবক মোখলেছুর রহমান রনি। সেদিন দেখার সুভাগ্য হলো এক বিশাল অভিজ্ঞতা। দুর্ঘটনায় নিহত বিউটি রায়ের শেষকৃত্যের যাবতীয় কাজ এবং তার আহত স্বামীকে চিকিৎসা সেবা নিজের হাতে করে যাচ্ছেন মোখলেছুর রহমান রনি। মহান আল্লাহতায়ালা যেনো রনি ভাইয়ের সৎ ইচ্ছে পুরা করেন। আমীন।
উল্লেখ্য, এক যুগ আগে কথাসাহিত্যিক ইকরামুল ইসলাম খান সম্পাদিত পাক্ষিক সংবাদ প্রতীক পত্রিকার ঢাকার বাংলা বাজারস্থ কার্যালয়ে আমি সহ-সম্পাদক পদে আসীন। সারা দেশের নবীন লেখকদের লেখা এডিট করা দায়িত্ব আমার কাঁধে। কবিতা সংকলনের উদ্দেশ্যে প্রথম দিন বিউটি রায়ের প্রেরিত তার একটি ছবি হাতে নিয়ে কথা হয়েছিল আমার। বিউটি রায় একটি কবিতা পাঠিয়ে ছিল সংবাদ প্রতীক পত্রিকায়। আজ বিউটির স্বামীর বড় ভাই বিকাশ কুমার বিউটি রায়ের একটি ছবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানান আমাকে। অর্থাৎ বিউটি রায়কে ছবিতেই দেখা, ছবিতে সীমাবদ্ধ। মহান সৃষ্টিকর্তা বিউটি রায়ের বিয়োগ শোক সইবার ধৈর্য দান করুক। বাস্তবে বিউটি রায়কে দেখা হলো না। সেকারণেই বলতে ইচ্ছে হয়-
'ভাগ্যপাতায় জীবনখানা বড়ই আঁকাবাকা;
পেয়ে হারানোর ব্যথা, না পাওয়ারই ছেঁকা।'
মহান আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন, কখন কি হয়, কখন কী হবে।
(এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)