রমরমা কোচিং বানিজ্য চলছে মণিরামপুরে। সকাল হলেই পৌর শহরের রাস্তায় যেন মিলন মেলা শিক্ষার্থীদের। পিঠে বই বহনের ব্যাগ নিয়েই বের হচ্ছে বাড়ি থেকে। এসব শিক্ষার্থীরা সবই কোচিং সেন্টার মুখি। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ ছুটির পাশাপাশি কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকার নির্দেশনা থাকার সত্ত্বেও এক শ্রেণীর শিক্ষকরা নিয়মিত কোচিং বানিজ্যে লিপ্ত রয়েছেন। মণিরামপুর পৌর শহরের বিভিন্ন স্পটে এ বানিজ্য করছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩২ জন শিক্ষক। উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় স্বস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে হরহামেশা এ কার্যক্রম চললেও দেখার যেন কেউ নেই ?
খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে, কোচিং বাণিজ্য এসব শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ইংরেজি বিষয়ে মণিরামপুর সরকারি কলেজের মোস্তাফিজুর রহমান, মনোহরপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক ইনামুল হক, মণিরামপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক মশিয়ার রহমান, মণিরামপুর ফাযিল মাদ্রাসার শিক্ষক উত্তম মন্ডল, রোহিতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যুৎ সরকার, মণিরামপুর ফাযিল মাদ্রাসার শিক্ষক সঞ্জয় সরকার, ঢাকুরিয়া কলেজের শিক্ষক শাহিন আলম, তালা সুভাশিনী কলেজের শিক্ষক গৌতম রায়, মণিরামপুর মহিলা কলেজের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল ফারুক এবং বালিয়াডাঙ্গা কলেজের শিক্ষক নুরুন্নবী। এসব শিক্ষকরা করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ এক বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটির সুযোগে সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেরে ইচ্ছামতো কোচিং বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে যথাযথ আইন থাকলেও তা প্রয়োগ হচ্ছেনা। এছাড়াও অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এ্যাসারমেন্টের নামে স্বাস্থবিধি উপেক্ষা করে প্রয়োজন অপ্রয়োজনে ডেকে আনা হচ্ছে। এতে অনেক শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।
এলাকা ঘুরে আরও জানা গেছে, মোস্তাফিজুর রহমান মণিরামপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক তিনি। দূর্গাপুর গ্রামে নিজ বাড়িতেই ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থী পড়ান। শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিদিন তার কাছে বিভিন্ন শ্রেণী ইংরেজির বিষয়ে পড়তে আসেন। মণিরামপুর মহিলা কলেজের শিক্ষক মাহামুদুল ইমরান বাবুল, পৌর শহরের গরুহাটা রোড়ের পাশেই নিজ বাড়িতে যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সকাল থেকে রাত অবদি তার বাড়িতে শিক্ষার্থীদের পদাচারণা রয়েছে। এ মাহমুদুল ইমরানের কাছে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে পড়েন। তবে গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে মাহমুদুল ইমরান পড়াচ্ছেন না বলে জানা গেছে। লাউড়ি মাদ্রাসার শিক্ষক ইনামুল কবির, মুক্তেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক গৌতম মন্ডল, মনোহরপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক ইনামুল হক, সুবলকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহেন মন্ডল এবং চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম নিয়মিত কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসিক নেন ৮’শ থেকে ১হাজার টাকা করে। এসব শিক্ষকদের কেউ কেউ ১’শ থেকে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়ান।
গণিত বিষয়ে পড়াচ্ছেন মণিরামপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক মশিয়ার রহমান, মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবদুস সবুর, ফজলুর রহমান, রোহিতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যুৎ সরকার, মণিরামপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ধিমান রায়, ফাযিল মাদ্রাসার শিক্ষক উত্তম মন্ডল। পদার্থ বিষয়ে পড়াচ্ছেন মণিরামপুর ফাযিল মাদ্রাসার শিক্ষক সঞ্জয় সরকার। রসায়ন বিষয়ে পড়াচ্ছেন ঢাকুরিয়া কলেজের শিক্ষক শাহিন আলম, মণিরামপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক নমিতা মন্ডল এবং মণিরামপুর ফাযিল মাদ্রাসার শিক্ষক সুকুমার রায়।
জীব বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াচ্ছেন তালা সুভাশিনী কলেজের শিক্ষক গৌতম রায়, মুক্তেশরী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক বিজন মন্ডল। আইসিটি বিষয়ে পড়াচ্ছেন মণিরামপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল ফারুক মাহমুদ, বিএম আবদুল হালিম, তালা সুভাশিনী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক পিন্টু। হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াচ্ছেন বালিয়াডাঙ্গা কলেজের শিক্ষক নুরুন্নবী ও অশোক চন্দ্র চন্দ। বাংলা বিষয়ে পড়াচ্ছেন মণিরামপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক আহাদ আলী এবং হাফিজুর রহমান।
খোঁজ খবর নিয়ে আরও জানাযায়, মণিরামপুর পৌরসভাধীন মোহনপুর, দূর্গাপুর, হাকোবা এবং গাংড়া একাংশে ভগবান পাড়ায় বাসা বাড়িতে কোচিং সেন্টার বানিয়ে এসব শিক্ষকরা মাসের পর মাস কোচিং বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসব বিষয়ে জড়িত শিক্ষকদের অনেকের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের অনেকেই দাবী করেন, আপাতত পড়ানো সীমিত করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন বর্তমানে পড়ানো স্থগিত রাখা হয়েছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা এবং উপজেলা প্রশাসন জানলেও প্রতিকারের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এমন নজির নেই।
উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন নং- ৭৩৬৬/২০১১ এর আদেশ বলে হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে ২০ জুন ২০১২, স্মারক নং- শিম/শাঃ১১/৩-৯/২০১১/৪০১ পত্রে শিক্ষকদের কোচিং বানিজ্য ঠেকাতে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে ৭নং কলামে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটি কোচিং বানিজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এছাড়া পরিপত্রে ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোচিং বানিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সেই শিক্ষকের এমপিও বাতিল অথবা এমপিও বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে জারিকৃত পরিপত্রে এমন আদেশ থাকলেও মণিরামপুর উপজেলা প্রশাসন এসব কোচিং বানিজ্য ঠেকাতে আজওবদি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার কোন নজির নেই।
এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে কোচিং বানিজ্য ঠেকাতে। তিনি আরো বলেন, করোনা এবং লকডাউনের কারণে অফিস ঠিকমত করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও কিছু অসাদুপয় শিক্ষকগণ চুরি করে এমন কর্মকা-ে জড়িত থাকতে পারে। তবে খুব শিঘ্রই খোঁজ খবর নিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।