করোনাকালে শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি কয়েকদফা বৃদ্ধি করে আগামী ১২ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। বুধবার (২৬ মে) দুপুরে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আগামী ১২ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। আমাদের সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ক্লাস নিতে পারবো।’
এর ঠিক দুইদিন পর শনিবার (২৯ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় প্রত্যাশা সংগঠনের আয়োজনে প্রয়াত আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর স্মরণসভায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ১৩ জুন থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর পরিস্থিতি খারাপ হলে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হবে না।
করোনার থাবায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি লন্ডভন্ড হয়েছে। করোনা মহামারিতে প্রায় ১৫ মাস ধরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান। বন্ধ আছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। থেমে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম। স্কুল-কলেজে অভ্যন্তরীণ কিছু পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। কিন্তু তাতে শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। ক্লাস বন্ধ থাকায় সরকার সংসদ টেলিভিশন, বেতার ও অনলাইনে ক্লাস নেয়ার উদ্যোগ নেয়। তবে সব শিক্ষার্থী এ সুবিধা পাচ্ছেন না। শহুরে কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করতে পারলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যার কারণে মোটেও অনলাইন ক্লাস করতে পারেননি। মফস্বলের শিক্ষকরাও অনলাইন ক্লাস নেন না। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এই বন্ধের ফলে চরম ক্ষতির শিকার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক্ষক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। করোনার প্রভাবে ব্যাপক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বেড়েছে বাল্যবিয়েও। শহুরে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে দেখা দিয়েছে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যাও।
করোনায় শিক্ষা খাতের ব্যাপক ক্ষতির চিত্রও উঠে এসেছে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন জরিপে। গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৯২ শতাংশ আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার এই সময়ে নিয়মিত পড়াশোনার একদম বাইরে রয়েছে। সম্প্রতিকালের এই গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ৯৭ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান। এসজিডি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফরম পরিচালিত এক জরিপে ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার তথ্য উঠে এসেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বাইরে রাখলে শিক্ষা নিয়ে ঝুঁকিও কম হবে না। সরকার শিক্ষার হার বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন মাসিক বৃত্তি ও অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু করোনায় যদি ঝড়ে পরার পরিসংখ্যান বৃদ্ধি পায় তাহলে ক্ষুন্ন হবে সরকারের শিক্ষা নিয়ে ইতিবাচক কর্মকান্ডের এই বিষয়টিও ভাবতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার পক্ষে মত বেশি আছে তাহলে রাজপথে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি করছে তারা কারা? জরীপে যে তথ্য এসেছে সেগুলোর কি হবে? ভেবে দেখা দরকার। কারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পক্ষে আর কারা খোলার পক্ষে তা বিবেচনা করা দরকার। আর সবকিছু খোলা রেখে ৫% কিভাবে সম্ভব তা আমার বোধগম্য নয়। ভেবে দেখা দরকার শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশগত দিক থেকেও।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, টিভি দেখে সময় ব্যয় করছে। করোনার সময়ে বেশ কয়েকজন অভিভাবক একটি বিষয়ে তাঁদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তা হচ্ছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও শিক্ষার্থীদের বাসায় অবস্থানের কারণে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ব্যবহার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সামগ্রী হাতের কাছে পেয়ে তার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আমাদের ছাত্রসমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন বা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে অল্প বয়সী বাচ্চাদের আজকাল ভারী চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইন্টারনেট আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, হজমে সমস্যা, ঘাড় ও কোমর ব্যথা, মোটা হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই আসক্তি তাদের খিটখিটে মেজাজ, অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি, টেনশন বোধ, বিষণ্নতা, পারিবারিক সৌজন্যবোধের অভাবজনিত বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। এছাড়া মোবাইল ব্যবহার করে করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারজনিত আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে যা তাদের পড়ালেখা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এই আসক্তি থেকে বের হতে না পরলে শিক্ষার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার এই সংকটকালীন চর কিংবা হাওর অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে আশঙ্কাজনক হারে। গবেষণা বলছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যে একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে আর্থিক অসঙ্গতি। করোনাকালের এই দুর্যোগে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা সন্তানদের কাজে পাঠিয়ে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের মতে, যুব সমাজের একটি অংশ শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন তৎপরতায় সক্রিয় আছে। অপর একটি অংশ রয়েছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। কেউ মাদকে যুক্ত, কেউ অবসাদে ভুগছে। আর এই বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কাই বেশি। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, কীভাবে তাদের সক্রিয় করা যায় তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। উপরোক্ত কারণ বিশ্লেষণ করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যুক্তিযুক্ত মনে হবে। তবে সবচেয়ে উত্তম হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয়ের সমন্বয়।
জীব ও জগতে উদ্ভিদ ও প্রাণী একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ঠিক একইভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এক অপরের উপর নির্ভরশীল। সুস্থ্যতা ছাড়া শিক্ষা লাভ হবে না আবার শিক্ষাহীন সুস্থ সমাজও কাম্য নয়। একইভাবে সকল কিছুর ক্রিয়া-বিক্রিয়া আছে। যেমন এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে শিশুরা। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার পক্ষে মত আছে অনেকের। কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে গিয়ে শিক্ষায় ঝুঁকি হতে পারে কি না সেটাও কিন্তু ভাবনার বিষয়।
সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয় গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ শিক্ষা ছাড়া সঠিক পথ উপলব্ধি করা যায় না, আবার সুস্থতা ছাড়াও সঠিক পথ গন্তব্যে পৌছানো সম্ভব না। যদি একসঙ্গে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না যায়, তাহলে যেখানে যখন পরিস্থিতি উন্নতি হবে, সেখানে আগে খুলে দেওয়া যেতে পারে। দিন ও শ্রেণি ভাগ করে দেখা যেতে পারে। এভাবে প্রথমে গ্রাম, তারপর উপজেলা ও জেলা শহরের স্কুলগুলো খুলে দেয়া যেতে পারে। সাথে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি কঠোর নজরদারী করা হোক। এভাবেই কিন্তু স্বাভাবিকের দিকে আসতে হবে। এটাই বাস্তসম্মত মত হতে পারে। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও ঝুঁকি কিন্তু কমছে না বা কমবে না কারণ সবই খোলা। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গেলেও বাড়িতে থাকছে না। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধির সমন্বয়ই হতে পারে সঠিক সিদ্ধান্ত। কমাতে পারে শিক্ষার ঝুঁকিও। সঠিক সময়ের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত খুবই জরুরী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট