নড়াইলের কালিয়ায় সরকারি পুকুর পুনখননের নামে পুকুর চুরির অভিযোগ উঠেছে। এলজিইডি বিভাগ থেকে হাতে নেয়া কালিয়া উপজেলার ৫টি সরকারি পুকুরের পুনখনন প্রকল্পের অধীন পুনখনন কাজে পুকুরের মধ্যবর্তী তলদেশ থেকে মাটি না কেটে শক্তিশালী ভেকু মেশিন দ্বারা পুকুরের চারপাশে গভীর করে মাটি কাটা হয়েছে ও পুকুরের পাড়ের ঢাল কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে, ওইসব পুকুরের পাড় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। শুধু তাই নয়, খননের অজুহাতে পুকুরগুলোতে ড্রেজারমেশিন বসিয়ে গভীর তলদেশ থেকে বালু তুলে সংশ্লিষ্টরা স্থানীয়দের কাছে অবাধে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাই, একরকম দায়সারা কাজ করেই প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পায়তারা চালাচ্ছে ঠিকাদারসহ তার সহযোগীরা।
উপজেলা প্রকৌশলীর অফিস থেকে জানা গেছে, উপজেলা পরিষদের হেলিপ্যাড পুকুরটিসহ ৫টি সরকারি পুকুর পুনখনন ঘাটলা নির্মাণের জন্য ৭১ লাখ ৫১ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে নড়াইল জেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিএম রফিকুল ইসলামকে ঠিকাদার নিয়োগ করেন। এর মধ্যে হেলিপ্যাড পুকুরের জন্য ১৫ লাখ ৮ হাজার ২২০ টাকা, উপজেলা পরিষদ পুকুর-১ এর জন্য ১২ লাখ ৯৬ হাজার ১০৬ টাকা, উপজেলা পরিষদ পুকুর-২ এর জন্য ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৮ টাকা, বড়দিয়া মুন্সি মানিক মিয়া কলেজের পুকুরে জন্য ১৪ লাখ ৫৮ হাজার ৩০২ টাকা ও বাগুডাঙ্গা সরকারি পুকুরের জন্য ১৫ লাখ ২৯ হাজার ১৮৬ টাকা ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। তবে, বাগুডাঙ্গা পুকুরটি ইতোমধ্যে ভরাট করে দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৪টি পুকুরের কাজ সিডিউল অনুযায়ী খনন করা হয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী ওই পুকুর খননের কাজ করা হয়নি। পুকুরগুলোর খননকাজ শুরু করার প্রায় ৩ বছরের মাথায় কালিয়া হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত উপজেলা পরিষদের হেলিপ্যাড পুকুরটি খননের অজুহাতে পুকুরের মধ্যে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে গভীর তলদেশ থেকে বালু তুলে ঠিকাদার স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই পুকুরের গভীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলনের ফলে কালিয়া হাসপাতালের আবাসিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ কারণে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া, উপজেলা পরিষদ-১ পুকুরটির চারপাশের পাড়ের ঢাল কাটার দৃশ্য চোখে পড়ার মত। অথচ, আনাবৃষ্টিতে পুকুরের তলদেশে গজিয়ে ওঠা ঘাসগুলো বৃষ্টিতে জমা সামান্য পানির ওপর বাতাসে দোল খাচ্ছে। পুকুরের পাড়ের ওপরে কর্তনকৃত মাটির পরিমাণ চোখে পড়ার মত নয়। ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু ও কাঁদা তোলার কারণে ইতিমধ্যেই পুকুরের ঢালের মাটি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার নয়া বারসাত গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে ইয়ার আলী মোল্যা, একই উপজেলার বলরামপুর গ্রামের মন্টু মোল্যার ছেলে আবদুল হাকিমসহ ৪ জন কালিয়া হাসপাতাল সংলগ্ন হেলিপ্যাড পুকুরটি খননের নামে পুকুরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে গভীর তলদেশ থেকে বালু তোলার কাজ করছেন। তোলা বালু পাইপের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ফুট দূরে কালিয়া হাসপাতালের সামনে একটি গর্ত ভরাট করতে দেখা গেছে। গভীর তলদেশ থেকে বালু তোলার কারণে হাসপাতালের আবাসিক ভবনসহ আশপাশের স্থাপনাগুলি হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি, পুকুরের পাড়গুলো সঠিকভাবে বাধাঁ হয়নি। তাছাড়া, অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া পুকুরগুলোর তলদেশে জন্মানো ঘাস গুলো রয়েছে অক্ষত।
স্থানীয় হাসান সরদার বলেন, ‘হেলিপ্যাড পুকুর থেকে তোলা বালু দিয়ে আমার বাড়ির গর্ত ভরাট করেছি। এজন্য আমি বালু ক্রয় করিনি। ঠিকাদারের লোকদের কিছু বকশিস দিয়েছি।’
মেসার্স এবিএম রফিকুল ইসলাম নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি হেলিপ্যাড পুকুরে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘বর্তমানে ওই পুকুরের বালু তোলার কাজ বন্ধ রয়েছে। পুকুরগুলো খননে কোন অনিয়ম হয়নি। উপজেলা পরিষদের-১ নম্বর পুকুরটিতে খননের পরে ঘাস জন্মেছে। বর্তমানে ঘাট বাঁধাইয়ের কাজ চলছে।’
তবে পুকুরে মেশিন বসিয়ে বালু ও কাঁদা তুলে খনন কাজ করার নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে ঠিকাদার এড়িয়ে যান।
সরকারি পুকুরগুলোর পূনখনন কাজের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত কালিয়া উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারি প্রকৌশলী আলী আহম্মেদ অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘হেলিপ্যাড পুকুর থেকে বালু তোলার কাজ বাদ দেয়া হয়েছে। মাসাধিক কাল আগে উপজেলা পরিষদ পুকুর-১ থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে কাঁদা তুলে খনন কাজ করা হয়েছে। সঠিক ভাবেই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।’
কালিয়ার ইউএনও মো. নাজমুল হুদা পুকুরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কাঁদা তোলার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের সামনের পুকুরটির খনন কাজে ড্রেজার দিয়ে কাঁদা তোলার বিষয় নিয়ে উপসহকারি প্রকৌশলী আলী আহম্মেদের সাথে কথা বলেছি। সঠিকভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাসপাতালের আবাসিক ভবন ঝুঁকি মুক্ত রাখতে হেলিপ্যাড পুকুর থেকে বালু তোলা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান।’
কালিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষ্ণপদ ঘোষ বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের ভেতরের পুকুর থেকে ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে কাঁদা তুলে ফেলা হয়েছে। অপরদিকে, হেলিপ্যাড পুকুরে ড্রেজার বসিয়ে গভীর তলদেশ থেকে বালু তুলে বিক্রির খরব শুনে ইউএনওসহ আমি পুকুর খনন কাজ পরিদর্শন করেছি। পুকুর সংলগ্ন হাসপাতালের আবাসিক ভবনগুলো ঝুঁকি মুক্ত রাখতে বালু তোলার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
নড়াইল জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুজায়েত হোসেন বলেন, ‘এ বিষয় খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’