মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫০ টি মডেল মসজিদের কাজ উদ্বোধন করলেন সম্প্রতি। তার সাথে সাথে লক্ষ্যনিয় যে, ধর্মচর্চায় বাংলাদেশি প্রায় ৯৭ শতাংশ সবিশেষ আগ্রহী। কিন্তু একটা জায়গায় একটু অবাক লাগছে। তরুণদের একটি অংশ মনে করে, মোবাইল, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আড্ডা ও পরিবার থেকে যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা না করা, পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে অনেকে ধর্মকে অধর্মের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ! গত ২ বছরে ধর্মীয় উন্মাদনায় ঘটেছে অনেক দুর্ঘটনা। আর পেছনে রয়েছে ‘হালাল কামাই’র ব্যাপারে সতর্ক না করে হারাম-ঘুষ-সুদ-মদ-জুয়াসহ যেভাবেই উপার্জন করা হোক না কেন দান করায় উৎসাহ বাড়ানো। তরুণদের অনেকের মত জেষ্ঠ নাগরিকরাও ভাবছেন অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি যা-ই করি না কেন একটি অংশ দান করে দিলেই সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর এসব ভ্রান্তি থেকেই বাড়ছে অন্যায় অপরাধী দুর্নীতি।
৯৭ শতাংশ তরুণ যেখানে ধর্মচর্চায় অনুরাগী, সেখানে এই ‘অনেক’ তরুণেরা কারা? আমাদের এক গবেষণাতে বেশির ভাগ উত্তরদাতা নিজের বা নিজেদের পরিচয় দেওয়া বা অন্যদের থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে সর্বাগ্রে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে জাতিসত্তা কিংবা নাগরিকত্বের পরিচয় অনেক পেছন থেকে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থেকেছে। তরুণ উত্তরদাতাদের মধ্যেও একই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এমতাবস্থায় আমার মনে প্রশ্ন এসেছে, যেসব তরুণ মনে করছেন ‘অনেক’ তরুণ ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছেন, তাঁরা আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? আমার তো মনে হয় যে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ নিজ নিজ ধর্মের রজ্জু প্রতিদিন আরও শক্ত করে ধরছেন। শুধু আচার পালনের ক্ষেত্রে নয়, বরং জীবনের যেকোনো দিক নিরিখ বা ঠিক-বেঠিকের বিচারে ধর্মকেই তাঁরা একমাত্র লেন্স, একমাত্র নিক্তি হিসেবে ব্যবহার করছেন। তারপরও অন্যায় পথে টাকা উপার্জন কমেনি। বেড়েছে ক্ষমতা দেখানোর প্রতিযোগিতা, টাকা কামানোর প্রতিযোগিতাও। এমনই একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পাবনার গণপূর্ত ভবনে অস্ত্র হাতে মহড়া দেওয়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সেই দুই নেতা তাদের লাইসেন্স করা শটগান দুটি থানায় জমা দিয়েছেন। সদর থানায় শনিবার রাতে উপস্থিত হয়ে অস্ত্র দুটি জমা দেন তারা। এ সময় করা জিডিতে তারা উল্লেখ করেন, ব্যক্তিগত কাজে জেলার বাইরে থাকবেন বলে অস্ত্র দুটি জমা দিয়েছেন। ওই দুই নেতা হলেন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এআর খান ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শেখ লালু। বিষয়টি নিশ্চিত করে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম আহম্মেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা লিখিত আবেদন করলে তা নথিভুক্ত করে শটগান দুটি জমা নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মাসুদ আলম বলেন, গণপূর্ত ভবনে অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। তবে বৈধ হলেও অস্ত্র নিয়ে সরকারি অফিসে মহড়া দেওয়া আইনের পরিপন্থী। কাজেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে অস্ত্র দুটির লাইসেন্স বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে।
এত বড় একটি অপরাধ দৈনিক কাগজের প্রথম পাতায় প্রকাশের পরও গ্রেফতার করা হচ্ছে না ক্ষমতার কারণে। বরং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এসবি) স্নিগ্ধ আখতার গণমাধ্যমকে বলেছেন, অস্ত্র হাতে তারা এত লোক নিয়ে কেন সরকারি অফিসে গেলেন- পুরো ঘটনাটি সদর থানার পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে।
আর গণমাধ্যম বলছে- ৬ জুন দুপুরে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ফারুক হোসেন তার লোকজন নিয়ে জেলা গণপূর্ত ভবনে যান। তার পেছনে শটগান হাতে ছিলেন ওই দুই নেতা। ভবনের সিসিটিভির একটি ফুটেজ শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রশাসন ও দলের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কিছু ঠিকাদার অভিযোগ করেন, ঠিকাদারি কাজের সুবিধা পেতেই আওয়ামী লীগ নেতারা এ মহড়া দিয়েছেন। এই অপরাধও যে দেশে পুলিশ প্রশাসন দেখতে পায় না, সে দেশে স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধুকে তো পুলিশের উপপরিদর্শক গুলি করে হত্যা করবেই। কেননা, বিচারের সংস্কৃতি নেই, নেই আইনের সংস্কৃতি। যা আছে, তা হলো ধর্ম ব্যবসা আর নারী লিপ্সুতা। তা না হলে ব্যবসায়ী কর্তৃক অপমানিত হয়ে কেন মুনীয়ার অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটবে? আর কেনই বা চিত্রনায়িকা পরীমনিকে হোটেলে হত্যা ও ধর্ষণ করার পরিকল্পনা করবে!
তবে বড়ই দুঃখের সংবাদ হলো- সারা দেশে বাড়ছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার। প্রভাবশালী রাজনীতিক থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বৈধভাবে পাওয়া অস্ত্র ব্যবহার করছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও আধিপত্য বিস্তারে। এমনকি অবৈধভাবে ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে এসব বৈধ অস্ত্র। প্রকাশ্যে এসব অস্ত্র উঁচিয়ে একদিকে যেমন ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, তেমনি ব্যবহার হচ্ছে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, এমনকি সরকারি উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতেও। এসব অস্ত্র দিয়ে ঘটছে খুনও। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু নির্বাচনে এসব অস্ত্রের অবৈধ মহড়া দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলের পদপদবি ব্যবহার করে অনেকেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে জেলা-উপজেলা শহরের সরকারি অফিসে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়ায়। এ ছাড়া ছড়িয়ে পড়েছে অবৈধ অস্ত্র। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের মতে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা আবারও তৎপর। দেশের সীমান্ত হয়ে অত্যাধুনিক সব অবৈধ অস্ত্র দেশে ঢুকছে। ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। সম্প্রতি নোয়াখালীতে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক অভিযোগ করেছেন, সারা দেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এ ব্যাপারে রাজনীতিকদের একটি বড় অংশ সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে, যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করলেও কমছে না অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি।
কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য নতুন নতুন অস্ত্র যোগ হচ্ছে কিশোর গ্যাং থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছোট বড় রাজনৈতিক গ্রুপে। সাথে সাথে সারা দেশে বেড়েছে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। গ্রাম থেকে শহরের অলিগলিতে প্রায়ই হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। গুলি করে চুরি, ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। পাড়া-মহল্লার ঝগড়া-বিবাদে ঘটছে গুলি। কিশোর গ্যাংদের হাতে মিলছে অস্ত্র। মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে ব্যবহার করছে অস্ত্র। সন্ত্রাসী, আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি তো পুরনো বিষয়। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন দেশে যখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকে তখন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তখন তুচ্ছ কারণেই অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়। চাঁদাবাজী-জঙ্গীবাদী-দখলদারি-নারী পাচারসহ নানা কারণে দেশে এখন অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেড়ে গেছে অপরাধপ্রবণতা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র ঢুকছে দেশে। আবার কখনো সীমান্তে কর্মরত বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় চোরাচালানের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয় অস্ত্র। সীমান্ত পার হলেই এসব মারণাস্ত্র চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, জঙ্গি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, চরমপন্থিদের হাতে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা দিয়ে অহরহ ঢুকছে আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। ছোটখাটো অপরাধী থেকে শুরু করে শীর্ষসন্ত্রাসী-গডফাদাররা মজুদ করছে অস্ত্রের ভান্ডার। আবার লাইসেন্স নিয়ে অনেকেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যেভাবে গোলাগুলি ঘটছে আগামীতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি আরও জোরালো ভূমিকা না রাখে তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হবে। এ ছাড়া অস্ত্রের চালান দেশে প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে আরও বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে বলে আমি মনে করি। রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ অস্ত্র যেন কেউ ব্যবহার করতে না পারে, এজন্য সবার আগে প্রয়োজন নীতির রাজনৈতিক চর্চা সকল দলের অভ্যন্তরে করা। তা না হওয়ার কারণে অস্ত্রবাজী বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যু-ধর্ষণ।
বিশে^র উন্নত দেশে শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্য অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আর আমাদের দেশে সন্ত্রাসীও অস্ত্র কিনতে পারে টাকা থাকলে। টাকা বেশি থাকার সুযোগে তো যুদ্ধরাপরাধী-দুর্নীতিবাজ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত মুসা বিন শমসের তাঁর সিকিউরিটি গার্ডদেরকে ভারি অস্ত্রই দিয়ে রেখেছেন, যা সম্পূর্ণভাবে বৈধতার বাইরে। অবশ্য একথাও সত্য যে, অপরাধীরা সব সময়ই অস্ত্রের মজুদ রাখে। শুধু তারা সময়-সুযোগ মতো জানান দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে। তাই অপরাধী যে-ই হোক মূল বিষয়টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দেখতে হবে তারা কতটুকু তৎপর। কারণ সিন্ডিকেটরাই দেশে অস্ত্রের চালান নিয়ে আসছে। আর এ সিন্ডিকেটদের সহযোগিতা করছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে তাদের আয়ত্তের বাইরে কী পরিমাণ অস্ত্র আছে। এসব উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হবে। প্রকাশ্য গোলাগুলিই ভীতির কারণ তৈরি করে দিচ্ছে। আর এসব আগ্নেয়াস্ত্র যদি অপরাধীর কাছে মজুদ থাকে তবে সমাজের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বেগ পেতে হবে। কারণ যতগুলো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সামাল দিতে হবে।
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি