“আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে হাজার মাইল দুরের তেপান্তর থেকে বলছি-বাবা তোমাকে স্যালুট। বাবা ত্যাগ স্বীকার করে লেখাপড়া না করালে আমিও হয়তো আজ একজন নর সুন্দর (নাপিত) হতাম। কিন্তু বাবার শ্রম, উৎসাহ, উদ্দীপনা আর প্রেরণায় আজ আমি প্রকৌশলী। জীবনে লেখাপড়া শিখে আজ আমি যেখানে এর সবটুকু অবদান আমার বাবার। বাবার চেষ্টাতেই আমি নিজের নামের পাশে প্রকৌশলী শব্দটি লিখতে পারছি।” আবেগঘন কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রামের মামুদপুর গ্রামের অদম্য মেধাবী তরুণ প্রকৌশলী মানিক কুমার শীল মিঠুন। মিঠুন ওই গ্রামের নরসুন্দর মহাদেব শীলের ছেলে।
সময়টা ১৯৯৯ সন। মহাদেব শীল তখন রয়না মোড়ে সেলুনে কাজ করেন। দুই ছেলে মেয়ে ও স্ত্রী সাধনা রাণী শীলকে নিয়ে ছোট সংসার। সেলুনে কাজ করে পাওয়া সামান্য আয়ে কোন রকমে দিন চলে যায়। তবে স্বপ্ন দেখেন ছেলে মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। কিন্তু অভাবের সংসারে কিভাবে সেটা করবেন সে দুশ্চিন্তাও রয়েছে তার। এরইমধ্যে প্রতিবেশী স্কুল শিক্ষক মিনারুল হক সরকারের পরামর্শে ছেলেকে ভর্তি করেন ভরতপুর বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অল্প দিনেই মানিক তার মেধার প্রমাণ দিয়ে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে। এরপর কৃতিত্বের সাথে ৫ম শ্রেণী পাশ করে।
অভাবের সংসারে ছেলেকে স্কুলে পড়তে দেয়ার বিষয়টি প্রতিবেশীদের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছে। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়ে বলেছে- লেখাপড়া শিখে কি করবে। তারচেয়ে তোমার সাথেই সেলুনে লাগিয়ে দাও, না হলে অন্য কোন দোকানে। কিন্তু তাদের সব টিকা-টিপ্পনী মুখ বুজে সহ্য করে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে ভর্তি করলেন পাশের রয়না ভরট সরকারবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর বড়াইগ্রাম ডিগ্রী কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকপাশ করে মানিক। ভর্তি যুদ্ধেও সফলতার সাথেই অতিক্রম করে মানিক। চারটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে অবশেষে কলেজ জীবনের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল মান্নানের সহযোগিতা ও পরামর্শে ভর্তি হয় রাজশাহী ইউনিভর্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এ- টেকনোলজি (রুয়েট) এ।
কিন্তু লেখাপড়ার বিস্তর খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। এ কারণে মানিকও মাঝে মাঝে প্রাইভেট পড়াতো। এরইমধ্যে একমাত্র মেয়ে কুমারী দোলা রাণী শীলও স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তার জন্যও খরচ আছে। তাই আর কোন উপায় না পেয়ে শেষে বাড়ি ভিটার দুই শতক জমি বিক্রি করে দেন তিনি। তবুও ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করতে হবে তার। বাড়ির ভিটা বিক্রির টাকার পাশাপাশি প্রতিদিন সেলুনে কাজ করে যা আয় হতো তার বেশির ভাগ অংশই পাঠাতেন ছেলের কাছে। এভাবে আয়ের প্রায় পুরোটাই ছেলের পেছনে খরচ করে বাড়িতে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে কেটেছে জীবনের বহুদিন। তারপরও ছেলে একদিন বড় হবে এমন স্বপ্নে সব কষ্ট ভুলে যেতেন তিনি। অবশেষে দরিদ্র বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে ২০১৬ সালে রুয়েট থেকে কৃতিত্বের সাথেই ইলেক্ট্রনিক্স এ- টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মানিক।
এবার সময় আসে ঘুরে দাঁড়াবার। দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখে বাবা-মা আর বোনটির জন্য কিছু করার। তাই বসে না থেকে প্রথম দুই বছর বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরী করেছে। এরপর সুযোগ পেয়ে বর্তমানে মানিক চীনের সাংহাই শহরে বিশ^খ্যাত সফটওয়ার কোম্পানি মাইক্রোসফ্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউক্রিসফ্ট সাংহাই লিমিটেডের অধীনে শেয়ার পয়েন্ট অনলাইন গ্লোবাল সাপোর্ট টিমের টেকনিক্যাল লিড হিসাবে কর্মরত আছে। ইতিঃমধ্যে মানিকের নিজের উপার্জনে বাড়ির অবশিষ্ট ভিটায় বাবা-মা আর বোনের জন্য গড়ে উঠছে আধুনিক বাবসভবন। একই সঙ্গে নিজের লেখাপড়ার জন্য বাড়িভিটার বিক্রিত অংশটুকুও পুনরায় কিনে নিয়ে বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন মানিক।
তবে সব কিছুর পরও নিজের পেশা নরসুন্দরের কাজ একেবারে বাদ দেননি মানিকের বাবা মহাদেব কুমার শীল। রোববার সরেজমিনে রয়না মোড়ে গিয়ে দেখা যায় তিনি সেলুনে কাজ করছেন। এ সময় তিনি বলেন, এ কাজ করেই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছি, মেয়েটাও ঢাকা তিতুমীর কলেজে অনার্সে পড়ছে। এ কাজটাকে আমি ছোট করে দেখি না, বরং শ্রদ্ধা করি। সে শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এখনও কাজ করি, তবে আগের মত সব সময় করি না, মাজে মাঝে অবসর সময় কাটানোর জন্য করি।
তিনি আরো বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নিরক্ষর। লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু শিক্ষার মর্মটা বুঝতাম। তাই নিজের সামান্য আয় থেকে টাকা বাঁচিয়ে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ, মেডিকেল কলেজ এগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতাম, এসব দেখে উৎসাহিত হতাম আর স্বপ্ন দেখতাম যদি আমার ছেলেমেয়েরাও এখানে পড়তে পারতো। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা আমার স্বপ্ন পুরণে করেছেন। আমি নাপিত হলেও আমার ছেলে একজন ইঞ্জিনিয়ার, আমার ছেলের জন্য আমি গর্বিত।
চীন থেকে মোবাইলে মানিক কুমার শীল এ প্রতিবেদককে জানান, “তবে আমার জীবনের সফলতার পেছনে বাবার অক্লান্ত শ্রমের পাশাপাশি দুজন শিক্ষকের অবদান স্বীকার অনস্বীকার্য। তারা হলেন আমার স্কুলের শিক্ষক মিনারুল স্যার, আর কলেজের শিক্ষক আবদুল মান্নান স্যার। তাঁদের অবদান-উৎসাহ আর বাবা-মায়ের সীমাহীন ত্যাগ আমার জীবন পুরো বদলে দিয়েছে। বাবা-মাসহ তাঁদের প্রতি আমি চীরঋণি। প্রার্থনা করি পৃথিবীর সব বাবাই যেন হয় আমার বাবার মতো।”