দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলের বেড়িবাঁধগুলোর বড় একটি অংশই ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। ফলে ভেসে যায় উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল। প্লাবিত হয় শত শত গ্রাম আর কয়েক হাজার মাছের ঘের। নষ্ট হয় উঠতি ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেলা। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর ওসব অঞ্চল থেকে এখনো নোনাপানি নামেনি। ফলে বাধ্য হয়েই শত শত পরিবার জলাবদ্ধ অবস্থায় জীবনযাপন করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলেই রয়েছে ৫ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার। যার পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প নেয়া হলেও তা তেমন কাজে আসেনি। বরং প্রডতিটি দুর্যোগের পরই জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ মেরামত করা হয়। এখনো টেশসই বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। ফলে সাতক্ষীরা-খুলনা-বরিশাল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো উপকূলই চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ষাটের দশকে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলোর নকশা করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বাঁধগুলোর উচ্চতা ১০ ফুট বলা হলেও বাস্তবে ৩ থেকে ৮ ফুটের বেশি নেই। ২০২০ সালের ১৮ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় অন্তত ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের দিনগুলোতে এমন উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে বেড়িবাঁধগুলো তা মোকাবিলা করতে পারবে না। তাছাড়া চিংড়ি চাষিরা ঘেরে লবণাক্ত পানি ঢোকাতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনেক চিংড়ি চাষিই ঘেরে পানি ঢোকাতে বাঁধে ছিদ্র করছে। অনেকে আবার বাঁধ কেটে তাতে পাইপ বসিয়ে দিচ্ছে। তাতে বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় ৮ শতাধিক মামলা হলেও চিংড়ি ঘের মালিকদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে জোয়ারের সময় পানি লোকালয়ে ঢুকছে। আর নদীতে জোয়ারের পানি নেমে গেলেও এলাকাগুলো থেকে পানি পুরোপুরি সরছে না। ফলে এলাকাবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের মূল বেড়িবাঁধের বাইরে অসংখ্য পরিবার অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। ওই এলাকার দক্ষিণ চালিতাবুনিয়া গ্রামে বলেশ্বর নদীর পাশে থাকা রিং বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় প্রতিদিন দু'বার পরিবারগুলো জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। ওই বাঁধটি গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ভেঙে গিয়েছিল। পরে সেটি মেরামত করা হলেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ফের ভেঙে যায়। আর ভাঙা বাঁধের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা স্থানীয় মানুষের স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছে। তাদের এখন গোসল, ধোয়া-মোছাসহ নিত্যদিনের সব কাজ নোনাপানিতেই সারতে হচ্ছে। তাছাড়া আশপাশের ধান চাষের জমিগুলোতে গলা সমান পানি জমে আছে। চাষের সময় চলে এলেও পানি না সরায় চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে কৃষকরা। শুধু দৈনন্দিন জনজীবন ক্ষতিগ্রস্তই নয়, জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার-ঘাট ভেঙে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও ব্যাহত হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে ওসব অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও। বেড়িবাঁধ ঠিকমতো সংস্কার বা পুনর্নিমাণ করা না হলে উপকূলীয় অঞ্চলে এসডিজির বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, অতীতে বেড়িবাঁধ সংস্কার, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে প্রতি বছর সরকারি কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, রিং বাঁধের উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুটের মতো ছিল। এবার মেরামতের সময়ে তা অন্তত ২০ ফুটের বেশি উঁচু করা জরুরি। একইসঙ্গে প্রতিবার ভেঙে যাওয়া ঠেকাতে বাঁধ মজবুত করে বানানো এবং জোয়ারে যেসব জায়গায় বেশি চাপ পড়ে, সেসব জায়গায় নিরাপত্তার খাতিরে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার করা উচিত। তাছাড়া বাঁধে গাছ লাগানো হলে প্রাকৃতিকভাবেই বাঁধ সাধারণের চেয়ে সবল হবে। বিশেষজ্ঞরাও বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, বাঁধ সংস্কারে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব জনগণকে দিতে হবে। বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ, বরাদ্দের টাকা খরচের খাত সম্পর্কে জনগণকে উন্মুক্তভাবে অবহিত করতে হবে। যাতে বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা তা জনগণ বুঝতে পারে। তাছাড়া সামাজিক নিরীক্ষা করে তা গণমাধ্যমকে জানাতে হবে। কত ফুট বাঁধ করা হবে এবং কাজ শুরুর সময়সহ নানা বিষয়ে জনগণের সঙ্গে আলাপ করেই পানি উন্নয়ন বোর্ড তা নির্ধারণ করবে। বাঁধ নির্মাণের পর সেটি টেকসই করার ক্ষেত্রেও জনগণকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। ওসব বিষয়ে গবেষকদেরও মতামত নিতে হবে। সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়লেই বাঁধ দীর্ঘস্থায়ী হবে।
এদিকে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে উল্লেখ করে পানি উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান, বিগত ২০১৩ সালের পানি আইন অনুযায়ী ২০১৮ সালে স্থানীয় পানি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ওই কমিটিকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সম্পৃক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালের দুর্যোগ আইন অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালের দিকে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ কমিটি হয়েছে। ওই কমিটিকে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সরকার দুটি আইন করে আলাদা দুটি মন্ত্রণালয়কে স্থানীয় জনগণকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছে।