আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এই জেলার আম স্বাদে ও গুণে সুমিষ্ট হওয়ায় অন্য জেলার তুলনায় এ জেলার আমের কদর অনেক বেশী। জেলাটি সীমান্তবর্তী এবং সোনামসজিদ স্থলবন্দর হওয়ার কারণে ভারতীয় করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়ে এ জেলাতে। যার ফলে করোনা সংক্রামের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলার মধ্যে গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর আমের হাট হচ্ছে একটি বৃহত্তর আমের বাজার। আম বাজারটিতে বাইরের বেপারীরা না আসায় প্রান চঞ্চল নেই। আশানুরূপ দাম পাচ্ছে না আম ব্যবসায়ীরা। এদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে রহনপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন থেকে সরিয়ে আমের বাজারটি দেড় কিলোমিটার দূরে রহনপুর পি এম কলেজ মাঠে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাজারটিতে ব্যবসায়ীরা শতশত ভ্যান ও মাটির উপর সাজিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন প্রজাতির আম সাজিয়ে রেখেছে। পা ফেলার জায়গা নেই। তবে গতবারের চেয়ে চাঙ্গাভাব কম।
বাগান মালিক জুয়েল জুয়েল আলী ও সংশ্লিষ্টরা বলেন, আম হলো এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার বড় উৎস। করোনাভাইরাসের কারণে আমকেন্দ্রিক এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে বাগান মালিক, আমচাষি,আমপাড়া শ্রমিক, কুলি-মজুর, আড়তদার ও পরিবহণ শ্রমিকসহ কয়েক লাখ মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। এ বছর আমের ফলন ভালো হলেও করোনায় আম চালানের গতি নেই। বাইরের বেপারী তেমন চোখে পড়ে না। ফলে ব্যবসায়ীরা আমের নায্যমূল্য পাচ্ছে না। বাজারে প্রথম দিকে গুটি আর গোপালভোগ আম দিয়ে ব্যবসা শুরু হলেও এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে খিরসাপাত, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ, গিরিয়াদাগী, কালিভোগ, রূপালী, ফজলি, হাড়িভাঙ্গা, দুধস্বর, লক্ষণা,মোহনভোগ, ভূজাহারি।
আম ব্যবসায়ী বাবু বলেন, করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেপারীরা না আসায় আমের বাজারে ধস নেমেছে। বাগান মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নিজেরাই কমিশনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আম বিকল্প হিসেবে পাঠাচ্ছেন। তবুও আম বাজারে এলাকার প্রত্যঞ্চল থেকে আম প্রচুর পরিমাণে আসছে। শনিবার রহনপুর আমবাজারে মন প্রতি খিরসাপাত (হিমসাগর) আম বিক্রি হচ্ছে ২০০০ থেকে ২৬০০ টাকা, হাড়িভাঙ্গা ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা, ল্যাংড়া ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা, ফজলি ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা, মোহনভোগ ও ভূজাহারি ১৪০০ ও ১৮০০ টাকা, লকনা ৯০০ থেকে ১৩০০ টাকা,কালিভোগ ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আম আড়ৎদার এম এ রহিম করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন,করোনা ভাইরাসের কারণে তাদের আমের চাহিদা বাইরে তেমন সাড়া ফেলে নি। কারণ লকডাউন চলমান রয়েছে। বাইরের বেপারীরা তেমন আছেনা। হাট-বাজারে মানুষের চলাচল কম থাকায় আম বিক্রি হচ্ছে কম। পূর্বের বছরগুলোতে আম আড়ৎদারেরা প্রতিদিন শতাধিকের উপর ট্রাক দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম পাঠাত। এখন তার অর্ধেকেও যাচ্ছেনা। তিনিও আরও বলেন, আমের বাজারটি নতুন স্থানে স্থানান্তর করা একটি প্রধান সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়া সংক্রমণের ভয়ে আমপাড়া শ্রমিক পেতেও সমস্যা হচ্ছে। মোকামগুলোতে চাষিরা আম আনলেও ব্যাপারীর অভাবে সেভাবে বিক্রি হচ্ছে না
রহনপুর আম আড়ৎদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মতিউর রহমান খাঁন বলেন, পুরো রহনপুর শহর এখন আমের গন্ধে মৌ মৌ করছে। আমের সুমিষ্ট ঘ্রাণ মন মাতিয়ে তুলছে ভোজনরসিকদের। পুণর্ভবা নদীর তীরে রহনপুর পিএম আইডিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে এবার বসেছে আমবাজার। গত ২২ মে থেকে এই বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে আম বেচা-কেনা। দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে ক্রেতারা যেমন বাজারে ভীড় করছেন তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের বাগান থেকে সতেজ আম নিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য আসছেন আম চাষীরা। সতেজ আমের বাহারী মিষ্টি রঙ, আর বিভিন্ন প্রজাতির আমের সমাহারে যেন ভিন্ন এক জগত তৈরি হয় আম বাজারে। এ বছর আমের ফলন ভালো হওয়ায় আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা আনন্দে রয়েছে। তবে করোনা ভাইরাসের কারনে বর্তমানে বাজারে আমের দাম কিছুটা কম থাকলেও আগামী দিনে ব্যবসায়ীরা ভালো করবে বলে তিনি আশাবাদী। ব্যবসার শুরুর দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আম রপÍানি কম হলেও বর্তমানে প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ টি আম ভর্তি ট্রাক রহনপুর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
অনলাইন ব্যবসায়ী আম-ম্যাংগোর পরিচালক পারভেজ শেখ, পিওর ম্যাংগোর পরিচালক রিফাতুজ্জামান রিফাত, হ্যালো ম্যাংগো চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিচালক হাসান আলী মন্ডল হিমেল, ম্যাংগো কর্ণারের পরিচালক তাসরিফ আহমেদ জানান, এবার আমের ফলন ভাল হওয়ায় ব্যবসা নিয়ে তারা প্রচন্ড আশাবাদী ও প্রচুর পরিমানে অর্ডারও পাচ্ছে। তবে বর্তমানে কুরিয়ার সার্ভিসের সেবার মান নিয়ে সাধারণ গ্রাহক ও অনলাইন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। সময়মত গ্রাহকের কাছে আম না পৌঁছানো, আম পঁচে যাওয়া ও ক্যারেট/কার্টুন কেটে লেবাররা আম বের করে নিচ্ছে, ডেলিভারি ম্যানরা অসদআচরণ করছে বলে অনলাইন আম ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন।
রহনপুর রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাষ্টার মামুনুর রশিদ মামুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত ২৭ মে থেকে রহনপুর চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ঢাকা গামী ম্যাংগো এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার কেজি পর্যন্ত আম পরিবহন করা হচ্ছে। প্রতিদিন ভালই বুকিং হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন,এবার গোমস্তাপুর উপজেলায় ৪ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে আমের ফলন হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৮৪৫ মেট্রিক টন। আমের ফলনের জন্য আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরন হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন। চলমান করোনা ভাইরাস ও লকডাউনের কারনে আম চাষী ও ব্যবসায়ীগণ আমের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তবুও সব শঙ্কা কাটিয়ে আম ব্যবসায়ীগণ উপকৃত হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, আম ব্যবসার সাথে জড়িত সকলকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ব্যবসা করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং বর্তমানে আম বাজার ব্যবস্থা খুব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সর্বদা প্রশাসনের সহযোগীতা থাকবে বলে জানান তিনি।