সমাজের ধনী বা স্বচ্ছল পরিবারের ব্যবহার্য পরিধেয় অথবা অতিরিক্ত বস্ত্র সাধারণ দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিতরণের মাধ্যম হিসেবে কয়েক বছর যাবৎ দেয়ালের এক কর্ণারে সাইনবোর্ড লিখে পুরাতন জামা-কাপড় ঝুলিয়ে রাখার (কনসেপ্ট) ধারণা তৈরী হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ বা এলাকার (গ্রাম-মহল্লা) পাকা করা দেয়ালের একটি অংশে রঙ দিয়ে চিহিৃত করে পুরাতন জামা-কাপড় জুলিয়ে রাখা হয়। দরিদ্র মানুষের জন্য এই সেবামূলক কাজকে “মানবতার দেয়াল” নামকরণ করে সমাজের কিছু সমাজ সচেতন মানুষ বা শিক্ষার্থীরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কিছু মানুষ মানবতার দেয়ালের এই কর্যক্রমকে অমানবিকতার কাজ বলেও মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা কাপড় চোপর গুলো এতোই পুরাতন, ছেড়া-ফাঁড়া ও নোংরা থাকে যা দরিদ্র মানুষদের প্রয়োজন থাকলেও তারা তা নিতে চায়না। এসব কাপড় ঐসব দেয়ালেই দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সেখানেই নষ্ঠ হতে থাকে। যতদুর জানাযায়, আজ থেকে ৫/৭ বছর পূর্বে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মানবতার দেয়ালের এই ধারণাটি তৈরী হয়। আমাদের দেশে ২০১৬ সালের জুন মাসে ওয়াল্ড ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর তাকুয়া কামাতা সোনারগাঁ উপজেলার ভট্রপুর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে এলে স্কুল কতৃপক্ষ “বন্ধুর প্রতি হাত বাড়িয়ে দাও” নামে একটি কর্ণার তৈরী করেন। পরবর্তীতে সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রাইমারী স্কুল পর্যায়ে “মহানুভবতার দেয়াল” নামে একটি কার্যক্রম শুরু করে। এর আওতায় মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “মহানুভবতার দেয়াল” নামে একটি কর্ণার উদ্ধোন করা হয়। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে তার নামকরন করা হয় “মানবতার দেয়াল”। মানবতার দেয়াল এর নামকরন যে নামেই হোক না কেনো এর উদ্দেশ্য ছিলো মহৎ। পরোবর্তীতে তা ভেস্তে যায়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো আমার কাছে যা অতিরিক্ত আছে, যার নেই তার জন্য ঐ দেয়ালে রেখে দাও।
সোনারগাঁ উপজেলার ভট্রপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বি, আর, বিলকিস বলেন, মানবতার নামে অমানবিকতা হবে কেনো। আমি যে জিনিসটি ব্যবহার করতে পারবো সেখানে সেই জিনিসটাই রাখবো। ব্যবহারের অনুপোযোগী জিনিসটা রাখবো কেনো।
সোনারগাঁ উপজেলা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি মিজানুর রহমান বলেন, দানের ফজিলত হলো, তোমরা যগৎ বাসীর প্রতি দয়া করো, রহম করো, তাহলে তোমাদের উপরে আকাশ ওয়ালা (আল্লাহ) দয়া করিবেন- (বুখারী মুসলিম)। মানবতার দেয়াল এটি অবশ্যই ভাল কাজ। মানুষের কল্যাণ করা, সাহায্য করা, পোশাক দান করা অত্যান্ত সওয়াবের কাজ। অনেক কবি-সাহিত্যিকেরাও তাদের লেখনির মাধ্যমে জনকল্যান মূলক কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। যেমন-
“হাসরের দিন বলিবেন খোদা
হে আদম সন্তান তুমি মোরে সেবা
করোনি যবে ছিনো রোগে অজ্ঞান”.....
আমাদের লক্ষ রাখতে হবে অন্য ভাইদের যাতে উপকার হয়। কেনো না রাসুল (সঃ) বলেছেন, “তুমি নিজের জন্য যেটা পছন্দ করোনা এটা তোমার অন্য ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করিওনা”। কিন্তু বর্তমানে সমাজের দিকে তাকালে দেখাযায় যেটা একেবারে নি¤œ মানের সেটাই দান করা হয়ে থাকে। সুতরাং এটা দানের নামে লজ্জাদান বা প্রহসন করা হয়ে থাকে।
সোনারগাঁ কাজী ফজলুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উত্তমকুমার রায় বলেন, কারো যা দরকার নেই ওখানে রাখবে। কারো যা দরকার ওখান থেকে নেবে। মানবতার দেয়াল-এর এই বিষয়টাতো যারপরনাই ভালো উদ্যোগ। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ওয়াল অব হিউম্যানিটি’ অথবা ‘ওয়াল অব কাইন্ডনেস’। তবে আমাদের দেশে এখন আর সেই অভাব নেই। সঙ্গে গার্মেন্টস ব্যবসার আকাশছোঁয়া সাফল্যে কাপড় এখানে এখন সহজলভ্য।
যদ্দুর জানা যায়, এই ধারণার শুরু ২০১৫ সালের দিকে ইরানে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো ইরানের ওপর অবরোধ চাপানোয় সেখানকার দারিদ্র্য প্রকট রূপ নিলে ওখানে মানবতার দেয়াল ধারণার উদ্ভব ঘটে। বাংলাদেশে সম্ভবত ওই বছরই মানবতার দেয়াল নামের কাজ শুরু হয়। তবে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ ও বিতরণের উদ্যোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। শত শত বছর ধরেই এই অঞ্চলের মানুষ একে অন্যকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে পুরনো কাপড়-চোপড় শহর ও গ্রামে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করার রীতি ছিল। তবে শীতকাল কিংবা জরুরি সাহায্যের প্রয়োজন ছাড়া পুরাতন কাপড় সংগ্রহ বা বিতরণ সম্ভবত খুব একটা কাজে আসছে না।
তাছাড়া, বর্তমান আমলে বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তন ঘটায় মানুষের প্রধান দুটি মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব আর নেই বললেই চলে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। এক দশক আগেও বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করত ভিক্ষুকরা। গ্রামে মজুরির অংশ হিসেবে নগদ অর্থের পাশাপাশি ধান-চাল কিংবা ভাত-তরকারি দেওয়ার প্রচলন ছিল। কারণ তখন ক্ষুধার কষ্ট ছিল।
সম্প্রতি দেখা যায়, অনেকে শো-আপ করার জন্য মানবতার দেয়াল-এর পথটি বেছে নেয়। ফলে কাজের কাজ কিছু হয় না। আবার অনেক অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মানুষনামধারীরা সাহায্যের ভং করে বিভিন্ন বর্জ্য এনে ওখানে ফেলে। ফলে মূল উদ্দেশ্যটি মার খাচ্ছে। মোদ্দা কথা সমাজে সামগ্রিকভাবে নৈতিকতা, শুদ্ধ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা না গেলে কোনো মানবিক উদ্যোগই কাক্সিক্ষত ফল পাবে না।