বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী হচ্ছে না। এর পেছনে মূল কারণ জালিয়াতি বন্ধের শঙ্কা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে একের পর এক যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় ও বিপণনে প্রতিযোগিতায় পেছনেই পড়ে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিমানে টিকিট কেনাবেচায় জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত একটি চক্রের নানা অপকৌশলের কারণেই বিমানের বুকিং, টিকিট বিক্রি, ভ্রমণ প্যাকেজসহ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুরোপুরি ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় আসছে না। মূলত জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ বন্ধ হওয়ার শঙ্কাতেই ডিজিটাল ব্যবস্থাপনাকে ওই চক্র ঠেকিয়ে রেখেছে। এমনকি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বিমানের নিজস্ব ই-কমার্স ব্যবস্থা তৈরি করা হলেও তার কার্যকারিতাও ওই চক্র নানা অজুহাতে ঠেকিয়ে রাখছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিমানের ওই অসাধু চক্রটি প্রচলিত গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (জিডিএস) বুকিং জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতি বছরে একশ কোটি টাকার বেশি লুটপাট করছে। আর গত দুই দশকে তা চলছে। বর্তমানে জালিয়াতিতে যুক্ত জিডিএস কোম্পানিকেই আবারো নানা কৌশলে নতুন করে বিমানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যদিও বিগত ২০১৯ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। দুই কমিটির রিপোর্টেই জিডিএসে বুকিং জালিয়াতির চালচিত্র তুলে ধরা হয়।
সূত্র জানায়, জিডিএস সেবা দেয়ার জন্য বিমানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৪টি কোম্পানির সঙ্গে বুকিং হলেই মূল্য পরিশোধ- এমন শর্ত রয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী জিডিএসের মাধ্যমে কেউ যদি শুধু বুকিং দিয় পরে তা বাতিল করে, তাহলেও জিডিএস কোম্পানি একটি সেগমেন্ট বিবেচনায় বিমানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে মূল্য পাবে। ওই শর্তের সুযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোতে অসংখ্য ভুয়া বুকিং করা হতো। কিন্তু বুকিংয়ের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত অর্ধেক টিকিটও বিক্রি হতো না। কারণ বেশির ভাগ বুকিংই ছিল ভুয়া। তাতে বিমানের বিপুল ব্যবসায়িক ক্ষতি হলেও বিক্রয় বিভাগ সংশ্লিষ্টরা লাভবান হয়েছে। সেজন্যই বিমানে টিকিট কাটার সময়ে যাত্রীরা অধিকাংশ সময় টিকিট নেই দেখলেও ফ্লাইটে ওঠার পর দেখতে পেতো অর্ধেক আসনই ফাঁকা।
সূত্র আরো জানায়, জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেগমেন্ট প্রতি মূল্য প্রকাশযোগ্য নয়। তবে ৪টি কোম্পানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে সেগমেন্ট প্রতি মূল্য ৭ থেকে ১৪ ডলার পর্যন্ত। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে জিডিএস বুকিং হলে এজেন্সি পাবে ৬ ডলার। শুধু বুকিং হলেও ওই অর্থ দিতে হবে। অথচ মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স এবং থাই এয়ারওয়েজের সঙ্গে জিডিএস কোম্পানির চুক্তির শর্তে দেখা যায়, সেখানে ফুল পেইড বাই প্যাসেঞ্জার শর্ত রয়েছে। যার অর্থ যাত্রী গন্তব্য অনুযায়ী সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে টিকিট কিনলেই কেবল সেগমেন্টের জন্য মূল্য পাবে সংশ্লিষ্ট জিডিএস কোম্পানি। জিডিএসের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তির এটাই আন্তর্জাতিক মানদ-। কিন্তু বিমান তা অনুসরণ করেনি। বিগত ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি জ্যাপওয়েজকে বিমানের অনলাইন টিকিটিংয়ের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন থেকে জ্যাপওয়েজকে প্রতি মাসে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ২৭ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। অন্যান্য খরচ বাবদ দিতে হয়েছে প্রতি মাসে অতিরিক্ত তিন হাজার ডলার। কিন্তু ওই কোম্পানির টিকিটে মূল্য সঠিক ছিল না। তার সফটওয়্যারে কোনো যাত্রী জনিির পরিস্থিতিতে যাত্রার তারিখ পরিবর্তন করতে পারতো না এবং একবার মূল্য পরিশোধ হলে পরবর্তী সময়ে অসঙ্গতির জন্য তা ফেরতের ব্যবস্থাও ছিল না। ওই প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সাল থেকে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলে এলেও ২০১৮ সালে এসেও স্মার্টফোনের জন্য মোবাইল অ্যাপ তৈরি করতে পারেনি।
এদিকে বিগত ২০১৯ সালে বিমান পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যের নেতৃত্বে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর জ্যাপওয়েজের সঙ্গে চুক্তি ও মূল্য পরিশোধে দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনিয়মের বিষয় উঠে আসে। তারপর একটি দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিমানের অনলাইন টিকিটিং ও ই-কমার্স পরিচালনার জন্য চুক্তি করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে বিমানকে প্রথমবারের মতো সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে ভ্রমণ প্যাকেজ ই-কমার্স সল্যুশন বিমান হলিডে তৈরি করে দেয়। পরে ২০১৯ সালে টিকিট বুকিং ও বিক্রি করতে ই-কমার্সের জন্য পূর্ণাঙ্গ ই-কমার্স অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। সেখানে ব্যবহৃত হয় একেবারে হালনাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি। সেক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী যাত্রী কর্তৃক সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ অনুযায়ী সেগমেন্ট মূল্য পরিশোধের শর্ত রাখা হয়। শর্ত অনুযায়ী দেশীয় কোম্পানিটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য ৫০ সেন্ট ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য দেড় মার্কিন ডলার পাচ্ছে।
অন্যদিকে সম্প্রতি বিমান অত্যাধুনিক পিএসএস ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনসহ ই-কমার্স ব্যবস্থাকে প্রধান করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। যে কারণে অত্যাধুনিক পিএসএস ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্র প্রক্রিয়ায় এমন একটি কোম্পানিকেই আবার কাজ দেয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়, যেটি অতীতে জিডিএস বুকিং জালিয়াতে যুক্ত ছিল বলে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টেই উঠে এসেছে। অথচ ওই কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতাও নয়। যে কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা হয়, সেটির বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু সেটিকে বাদ দিতে অসঙ্গত কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। তার মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে, বাধ্যতামূলক জিডিএস ট্যাপ থাকা। অথচ আধুনিক সময়ে অন্য সব এয়ারলাইন্স সর্বাধুনিক পিএসএস ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়। টিকিট বিক্রিতে অনলাইন বা ই-কমার্সে সর্বনিম্ন মূল্য রাখে। অথচ বিমান সর্বাধুনিক ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের নামে পুরোনো ব্যয়বহুল ব্যবস্থাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তাফা কামাল জানান, বিমানের নিজস্ব কোনো ই-কমার্স সল্যুশন নেই। দেশীয় তৃতীয় পক্ষ সল্যুশন প্রোভাইডারের মাধ্যমে বিমান ই-কমার্স কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় সল্যুশন কেবল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সে এর প্রসার ঘটেনি। তবে বিশ্বের অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মতো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও আধুনিক ও বিশ্বমানের পিএসএস এবং ই-কমার্স সিস্টেম ব্যবহারে বদ্ধপরিকর। পুরোনো পিএসএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিতা রিজারভেশন সিস্টেমের পরিবর্তে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পিএসএস, জিডিএস, ডিসিএস এবং ই-কমার্স প্রতিস্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছে। বিমানে বিশ্বমানের প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস) প্রতিস্থাপনে ও ই-কমার্স স্থাপনে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।