মৌসুমের ভারি বর্ষণে সাতক্ষীরার নিম্নাঞ্চল পানিতে একাকার। ভেসে গেছে সদ্য রোপা আমন, আমনের বীজতলা ও মাছের ঘের। পানিতে টইটুম্বুর করছে জেলার সাত উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়ন আর দুই পৌরসভার নিম্নাঞ্চল।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে গত ২৭ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত তিন দিনের বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সাড়ে ১৯ হাজারের অধিক চিংড়ির ঘের। তিন মাস আগে জলোচ্ছ্বাস ইয়াসের প্রভাবে ঘেরের ১৬ কোটি টাকার ক্ষতির পর এখন মাত্র তিন দিনের বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ৫৩ কোটি টাকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতক্ষীরা পৌরসভার বেশির ভাগ নিচু এলাকা এখন পানির নিচে। পৌরসভার ইটাগাছা এলাকার বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম জানান, সামান্য বৃষ্টিতেই এ এলাকা তলিয়ে যায়। চারদিকে জমে থাকা পানি বের হওয়ার সুযোগ নেই। এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থাও নেই।
সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির নেতা আলী নুর খান বাবুল জানান, পৌরসভায় পানিনিষ্কাশনের যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছে। গুটি কয়েক লোক পৌরসভার মধ্যে অপরিকল্পিত মৎস্য ঘের করার কারণে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
মাত্র দুই দিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে পৌরসভার ইটাগাছা, কামাননগর, রসুলপুর, মেহেদিবাগ, মধুমোল্লারডাঙ্গী, বকচরা, সরদারপাড়া, পলাশপোল, পুরাতন সাতক্ষীরা, রাজারবাগান, বদ্দিপুর কলোনি, ঘুড্ডিরডাঙি, কাটিয়া মাঠপাড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
এদিকে সদর উপজেলার ধুলিহর, ফিংড়ি, ব্রহ্মরাজপুর, লাবসা, বল্লী, ঝাউডাঙা ইউনিয়নের বিলগুলোতে রোপা আমন ও বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সাতক্ষীরা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাণসায়ের খালও পানি টানতে পারছে না। প্লাবিত এলাকার কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে।
অতিবৃষ্টির ফলে গদাইবিল, ছাগলার বিল, শ্যাল্যের বিল, বিনেরপোতার বিল, রাজনগরের বিল, কচুয়ার বিল, চেলারবিল, পালিচাঁদ বিল, বুড়ামারা বিল, হাজিখালি বিল, আমোদখালি বিল, বল্লীর বিল, মাছখোলার বিলসহ কমপক্ষে ২০টি বিল ডুবে গেছে। এসব বিলের মাছের ঘের ভেসে গেছে পানিতে।
বেতনা নদীর তীরবর্তী বিলগুলোর পানি নদীতে নিষ্কাশিত হতে না পেরে পৌর এলাকার ভেতরে ঢুকছে। সবজি ক্ষেতগুলো ভাসছে পানিতে। মানুষের যাতায়াতেও ভোগান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে উপকুলীয় উপজেলা শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, আশাশুনিসহ জেলার সাতটি উপজেলা। সেখানে প্রধান রাস্তার ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, আনুলিয়া, খাজরা, বড়দল, শ্রীউলা, আশাশুনি সদরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পানিতে থইথই করছে।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমাড়ি, কৈখালী, রমজাননগরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নেরও চিত্র একই। বসতবাড়িতে উঠেছে পানি। হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্লাবিত এলাকার মানুষ।
তালা উপজেলার ইসলামকাটি, মাগুরা, কুমিরা, খেশরা, তেঁতুলিয়া, ধানদিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সবজিক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের।
কালীগঞ্জের রতনপুর, কালিকাপুর, বিষ্ণুপুর, মথুরেশপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মাছের ঘের, পুকুর ও সবজিক্ষেত ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দেবহাটার কোমরপুর, পারুলিয়া, সখীপুর ও নওয়াপাড়া ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় পানিতে তলিয়েছে পুকুর ও ঘের।
কলারোয়ার জয়নগর, ধানদিয়া, যুগিখালি, সোনাবাড়িয়া, শ্রীপতিপুর, ব্রজবকসসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কে পানি ওঠায় ব্যহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গত ৫ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে এটাই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। জেলায় তিন দিনে ২২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম জানান, ভারী বর্ষণে নিম্নাঞ্চলের ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলার ক্ষতি হয়েছে। আর ৮৬০ হেক্টর রোপা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ৫০০ হেক্টর জমির সবজিরও নষ্ট হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সাতক্ষীরায় মাছের ক্ষতি হয় ১৭৬ কোটি টাকা। ইয়াসের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি হয় ১৬ কোটি টাকা। সবশেষ এই বৃষ্টিতে ব্যাপক বর্ষণে ৫৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে আশাশুনির শ্রীউলা এলাকার ঘের ব্যবসায়ী আলাউল ইসলাম বলেন, ‘বছরে তিন থেকে চারবার আমাদের মাছের ঘের ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ৫০ বিঘার একটি ঘেরে আম্পানে আমার ক্ষতি হয়েছিল ২০ লাখ টাকা। ইয়াসে ক্ষতি ছিল ৫ লাখ টাকা। আর বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে ঘের ভেসে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা।’
ফি বছর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী আলাউল ইসলাম, সাহিদ হাসানসহ অনেকে বলেন, তারা আগামীতে ঘের ব্যবসা বাদ দেবেন।
শ্যামনগরের পদ্মপুকুর এলাকার ঘের ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান জানান, তার ১০০ বিঘার একটি ঘের রয়েছে। তার ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা। ব্যাংক ঋণ কীভাবে শোধ করবেন এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ ন ম আবু জর গিফারী বলেন, ‘আমার উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ২০ টন চাল দেয়া হয়েছে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার ১৯ হাজার ৪৫৯টি মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মাছের ক্ষতির পরিমাণ ৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ঘর-বাড়িসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পাবার পর কোথায় কেমন বরাদ্দ করতে হবে তা বুঝতে পারব।
তিনি আরও বলেন, ‘চলমান অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলাব্যাপী ঘেরের সকল অবৈধ নেট-পাটা স্থাপনকারীকে স্ব-উদ্যোগে অপসারণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় নেট-পাটা স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।