ঠিক সাত বছর আগে ২০১৪ সালের পহেলা আগস্ট ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে ঘটেছিল ভয়াবহ মর্মান্তিক ঘটনা। নাম ছিল ফুলহরি ট্র্যাজেডি। সেদিন একটি বরযাত্রীবাহী বাস ট্রেনের ধাক্কায় চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যায়। বরযাত্রা পরিণত হয় শোকযাত্রায়। ঝরে যায় ১২টি তরতাজা প্রান। একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নাড়া দিয়েছিল পুরো দেশকে। ফুলহরি ট্রাজেডির ৭ বছর পার হলেও এখনো তাদের কান্না থামেনি। প্রিয়জনদের হারিয়ে পরিবারের অনেকেই নির্বাক। সেদিনের কথা মনে করে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ২০১৪ সালের ১লা আগস্ট কালীগঞ্জ বারোবাজার রেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অবহেলায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পরে বরযাত্রীবাহী বাসটি। বাসটি কালীগঞ্জের সাকো মথনপুর থেকে শৈলকুপার ফুলহরি গ্রামে ফিরছিলো। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় একই পরিবারের নারি ও শিশুসহ নিহত হন ১২ জন বরযাত্রী। দুর্ঘটনায় নববধু জোছনা ও বর তাপস কুমার ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও নিহত হন একই পরিবারের ৩ সদস্যসহ শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের ৭ জন। দুর্ঘটনায় আহত হন অন্তত ৬০ জন। এর মধ্যে হাত, পা ও মেরুদন্ড ভেঙ্গে পঙ্গু হয়ে গেছেন ২২ জন। নিহতদের মধ্যে শুভন কুমার দে ও বিপ্লব কুমারের পরিবারে কোন পুরুষ সন্তান নেই। নিহতরা হলেন, শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের অনিল বিশ্বাসের ছেলে সুধির কুমার (৪০), একই গ্রামের জগবন্ধু বিশ্বাসের ছেলে বিপ্লব (২৫), মহাপ্রসাদের ছেলে শোভন কুমার দে (১৫), আবাস সাহার ছেলে সুজয় সাহা (৩০), সুধির কুমারের ছেলে অলোক কুমার (২৮), কালিপদ সাহার ছেলে কলেজ শিক্ষক রিপন কুমার সাহা (২৩), কৃষ্ণ গোপালের ছেলে রবি গোপাল, ঝিনাইদহ গোবিন্দুপর গ্রামের বিমল কুমার, ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকার বলাই দাসের ছেলে উজ্জ্বল দাস (২৮), কালীগঞ্জ ভুষনস্কুল পাড়ার রঞ্জন কুমারের স্ত্রী বর্ণা (৩৫), ছেলে কৌশিক (৮) ও ভাগ্নি ভবেশ কুমারের মেয়ে কৃষ্ণা (৩০)। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ হারিয়ে অনেক পরিবার এখনো অভাব অনটনে ভোগছেন।
আবার চিকিৎসার অভাবে যন্ত্রণা সঙ্গী করে দিন পার করছেন অনেকেই। ঘটনার পর দায়ের হওয়া মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। এমন অবস্থায় পালিত হচ্ছে ফুলহরি ট্র্যাজেডির ৭ম বার্ষিকী। ঘটনার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে ও সরকারের পক্ষ থেকে যে সহযোগিতার আশ্বাস মিলেছিল তা পাননি ক্ষতিগ্রস্থরা। বারোবাজার রেলক্রসিংয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর স্টেশন মাস্টার আবু সুফিয়ান তুর্কি ও গেইটম্যান আবদুর রহমানসহ তিন জনকে বরখাস্ত এবং বাস চালক রমজান আলীকে দায়ী করে ঝিনাইদহ জেলা প্রমাসনের পক্ষ থেকে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। তদন্ত রিপোর্টে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোধে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশে বারোবাজার রেল লাইনের উপর বসা মাছের হাট উচ্ছেদ করার কথা বলা হয়। কিন্তু সে হাট আজো আছে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার স্মতি চারণ করতে গিয়ে সে দিনের নববধূ জোসনা রানী বলেন, সারাজীবন আমাকে দুঃসহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। সবার সাথে হয়তো মিলেমিশে একসময় স্বাভাবিক হবো। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে ১২ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। এই দুঃসহ স্মৃতি কি ভাবে ভুলে থাকবো সেটাই ভাবছি। বর তাপসের ভাবি লক্ষিরানী জানান, দুর্ঘটনার কারণে শুধু তাদের পরিবার নয় গোটা গ্রামের মানুষের সব আনন্দ মুছে যায়।
দুর্ঘটনা কবলিত সীমান্ত এক্রপ্রেস ট্রেনটি সৈয়দপুর থেকে খুলনার দিকে যাচ্ছিল। ট্রেনটি বাসটিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়। এ সময় আশপাশে ছিটকে পড়তে থাকেন বাসযাত্রীরা। প্রায় দেড় কিলোমিটার পার হয়ে ট্রেনটি থামানো হয়।
আহত বাসযাত্রীরা জানান, তারা ঝিনাইদহের শৈলকূপার ফুলহরি গ্রাম থেকে সনাতন ধর্মের একটি বিয়ে অনুষ্ঠানে বরযাত্রী হিসেবে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সাঁকো গ্রামে যান। বাসটিতে ৭০ জনের বেশি বরযাত্রী ছিলেন। ফেরার পথে ভোর তারা দুর্ঘটনা কবলিত হন।
কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার সাঁকো মথনপুর গ্রামের সুবল বিশ্বাসের মেয়ের বিয়ে শেষে বরযাত্রীবাহী বাস বারোবাজার রেললাইন ক্রসিং অতিক্রম করছিল। বারোবাজারের বাসিন্দা আজাদ হোসেন অভিযোগ করেন, রেলক্রসিংয়ে ২ জন গেটম্যান মমিন ও হুমায়ূনের ডিউটি ছিল। কিন্তু শুক্রবার দুর্ঘটনার সময় তারা সেখানে ডিউটিরত ছিলেন না। ফলে এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে।