বাধার মুখে পড়ছে সরকারের অর্থনৈতিক জোনে বেসরকারি খাতের বড় বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক জোনগুলোতে বড় বিনিয়োগে অর্থায়নের ক্ষেত্রে গ্যাস, বিদুৎ, পানি সমস্যার চেয়েও এখন বড় সমস্যা জামানত জটিলতা। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্পের জমি সরকারের মালিকানাধীন থাকার ফলে ওই জমি জামানত হিসেবে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের সেখানে জমির মালিকানা পাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া দেশে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক জোন পৃথক পৃথক নীতিতে পরিচালিত হওয়ায় জামানতের ক্ষেত্রে জটিলতা আরো বেড়েছে। মোংলা অর্থনৈতিক জোনে উদ্যোক্তারা রেজিস্টার্ড মর্টগেজ সুবিধা পেলেও দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে খ্যাত মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে রেজিস্টার্ড মর্টগেজ সুবিধা নেই। ওই কারণে সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত জমি জামানত রেখে ঋণ গ্রহণের সুবিধা পাচ্ছে না উদ্যোক্তারা। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,শুধুমাত্র দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোই নয়, জামানত জটিলতায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) খাতে গৃহীত বড় বড় প্রকল্পগুলোও বছরের পর বছর ধরে আটকে রয়েছে। অর্থায়নের অভাবে ওসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ পিপিপি কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বেশ কিছু সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো ওই চিঠিতে পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) উল্লেখ করেন, প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের পর বেসরকারি অংশীদারগণ যে প্রকল্প কোম্পানি বা প্রকল্পের নামে যে একটি বিশেষ কোম্পানি গঠন করে থাকে, ওই কোম্পানির পক্ষে ঋণ গ্রহণের জন্য জামানত প্রদানের সক্ষমতা থাকে না। কেন না, প্রকল্পের জমি যেহেতু সরকারের মালিকানাধীন থাকে, ওই জমি জামানত হিসেবে দেয়ার সুযোগ নেই। ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রকল্পে অর্থায়ন দ্রুত করার জন্য ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (পিপিপি ফাইন্যান্সিং পার্টনারশিপ) করলেও বাস্তবে বেসরকারি উদ্যোক্তারা আর্থিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়ছে।
সূত্র জানায়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কর্মকর্তারাও অর্থনৈতিক জোন এবং পিপিপি প্রকল্পে বড় বিনিয়োগে অর্থায়নের ক্ষেত্রে জামানত জটিলতার বিষয়টি স্বীকার করেছে। তাদের মতে, ইকনোমিক জোনগুলোর প্রপাটির মালিক যেহেতু সরকার, সে কারণে ওই জমি বেসরকারি উদ্যোক্তারা জামানতে ব্যবহার করতে পারেন না। এ সমস্যা সমাধানে বিডার পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা করার বিষয়ে বেজাকে তাগিদ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগে ঋণ প্রদান সংক্রান্ত একটি কমিটিও আছে, যার চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সাচিবিক দায়িত্বে রয়েছে বিডা। ওই কমিটির পক্ষ থেকেই এ ধরনের নীতিমালা করার প্রস্তাব ছিল। এখন জামানত সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে নীতিমালা হোক বা বিধিমালা হোক একটা কিছু করতে হবে। নয়তো পরে বড় বড় বিনিয়োগের প্রস্তাব এলেও সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হবে।
সূত্র আরো জানায়, ঋণ প্রদানে জামানত জটিলতা শুধু সরকারি জমির ক্ষেত্রে নয়, বেসরকারি জমি নিয়েও উদ্যোক্তারা নানা সমস্যায় পড়ে। দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে একদিকে যেমন বেসরকারি জমি রেজিস্ট্রেশনের বিষয়গুলো সহজীকরণ করা প্রয়োজন, পাশাপাশি সরকারি জমি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের নামে এমনভাবে বন্দোবস্ত দেয়া উচিত যাতে অর্থায়ন দ্রুত হতে পারে।
এদিকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে জটিলতা এড়াতে ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর ২৬-এর (খ)(১) এবং ২০১৬ সালের ১৬ মে প্রকাশিত বিআরপিডির একটি প্রজ্ঞাপন সংশোধনের সুপারিশ করেছে পিপিপি কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি পিপিপি প্রকল্পের জন্য একক ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বন্ড মার্কেট তৈরি, পেনশন ফাইন্ড, ইন্সুরেন্স ফান্ড থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। পিপিপির কর্মকর্তাদের মতে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬(খ)(১) এবং বিআরপিডির সার্কুলার অনুযায়ী কোনো প্রকল্পে ব্যাংক মোট মূলধনের সর্বাধিক ৩৫ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করতে পারে না। অথচ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। আইনগত দিক থেকে ব্যাংকগুলো এককভাবে ওই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে সক্ষম নয়। তাছাড়া স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রভিশনিংয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসরণ করতে হয়। এমন অবস্থায় পিপিপি প্রকল্পে দ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনসহ বড় বিনিয়োগে জামানত জটিলতা দূর করার বিষয়ে সরকারকে সুনির্দ্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ জরুরি।