পিতার অভাব অনটনের সংসার। কখন এক বেলা আবার কখন না খেয়ে জীবন যাপণ করেছেন। গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর বড়বাজারে তরকারী পট্টি পিতার ছোট একটি চায়ের দোকান। সেখানে পিতার সাথে চা বিক্রি করেছেন মাধ্যমিক বিদ্যালয় পড়া পর্যন্ত। চায়ের দোকানে চা বিক্রিসহ মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে ক্লাস করতেন। অদম্য ইচ্ছা লেখাপড়া শেষে বড় কর্মকর্তা হওয়া। সম্প্রতি এনটিআরসি কর্তৃক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় কলেজ শাখায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। নড়াইল জেলার গোবরা মহিলা কলেজে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পৌর এলাকার ইসলামনগর মহল্লার চা বিক্রেতা দুরুল ইসলামের তৃতীয় সন্তান খোতিজা খাতুন বনি। পিতা-মাতাসহ সাত ভাই বোন নিয়ে ৯ জনের সংসার। অভাব অনটনের সংসারে থেকেও এক পরিশ্রমি শিক্ষার্থী খোতিজা খাতুন বনি কৃতিত্বের কথা এলাকায় আলোচনায় পরিণত হয়েছে।
পরিবার ও স্থানীয়রা জানায়, পাঁত বোন ও দুই ভাইবোনের মধ্যে বনি তৃতীয়। তাঁর পিতা রহনপুর পৌর এলাকার তরকারীপট্টিতে চায়ের দোকান করেন। ৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারটি সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয় চা বিক্রেতা দুরুলের। চা বিক্রি করে অনেক কষ্টে তাদের জীবন চলে। ছোট বয়স থেকে পিতার দোকানে চা বিক্রি করেছেন পরশ্রমি বনি। অনেককে বলতেন বড় হয়ে অফিসার হবেন। চা বিক্রির পাশাপাশি ফাঁকা সময়ে বই পড়তেন। মাধ্যমিক পর্যন্ত দৈনিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারেন নি। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকতেন। দোকানে আর বাড়িতে বেশিরভাগ সময় লেখাপড়া করতে হয়েছে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ২০১০ ও ২০১২ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হয়। পরিবারের সমস্যার কারণে একাদশ শ্রেণী মেধাবী বনিকে রহনপুর মহিলা কলেজ ছাত্রী নিবাসে থাকার অনুমতি দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাঁর সকল খরচ বহন কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে রাজশাহী বিদ্যালয়ে
দর্শণ বিভাগে ভর্তি হয়। বনির লেখা পড়ার আগ্রহ থাকায় পিতা-মাতা বাড়ির পোষা হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করে তাঁকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। কিন্তু তাঁর দুশ্চিন্তা লেগে লাগে কিভাবে পড়ালেখা চালাবে। একপর্যায়ে তিনি টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া খরচ চালাত । পরবর্তী অনার্স ও মাস্টার্স প্রথম শ্রেণী এ উত্তীর্ণ হয়। এরই মধ্যে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক নড়াইল সদর গোবরা মহিলা কলেজের যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে প্রভাষক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ।
বিষয়টি নিয়ে খোতিজা খাতুন বনির গর্ভধারিনী মা বলেন, তাঁর মেয়ে ছোট থেকেই কষ্ট করে চায়ের দোকানে কাজ করেছে। পরিবারকে সহযোগিতার কারণে বিদ্যালয়ে যেতে পারত না। তবুও বনি থেমে থাকেনি। পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। এমনকি লেখাপড়ার খরচের জন্য পাশের একটি বাড়িতে দু'বছর কাজ করেছে। বিনা খরচে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করে। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সুযোগ পায়। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যার হওয়ায় এক বছর সময় নষ্ট করে আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। সেখান থেকে সে ভাল ফল করে কলেজ শিক্ষিকা হয়েছে। তাঁর পরিবার খুবই খুশি।
বনির পিতা দুরুল ইসলাম বলছেন, রহনপুর বাজারের তরকারী পট্টিতে তাঁর একটি চায়ের দোকান আছে। দোকানটি প্রায় ২০ বছর ধরে চা বিক্রি করে থাকি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনের পথ হচ্ছে ওই চায়ের দোকানটি। বড় ছেলে কাঁঠের মিলে কাজ করে। তাঁর কাজের টাকার কিছু অংশ পরিবারকে দিয়ে সাহায্য করে। ছোটবেলায় থেকে চায়ের দোকানে কাজ করত তার তৃতীয় সন্তান বনি। লেখাপড়ার প্রতি তার ঝোক ছিল। দুর্ভাগ্য যে,অভাবী সংসারে মেয়েকে আর্থিকভাবে তেমন সহযোগিতা কখনো করতে পারতাম না। বাড়ি থেকে কেবলমাত্র মাঝে মধ্যে চাল ও তরকারির কিনে দিতাম। আমার মেয়েটা চায়ের দোকানে থেকে অনেক কষ্ট করে এতদূর পর্যন্ত এগোতে পেরেছে। মেয়ের জন্য সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন। তাঁর ইচ্ছে যেন আল্লাহ পূরণ করেন।
এ বিষয়ে খোতিজা খাতুন বনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক কলেজে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। নড়াইল সদর গোবরা মহিলা কলেজের যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করবেন। তিনি ১৫তম এনটিআরসিএ পরীক্ষায় সারা দেশে ষষ্ঠ হয়েছিলেন। ৪১তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর স্বপ্ন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বড় কর্মকর্তা হওয়া। এ লক্ষ্যে বর্তমানে রাজশাহীতে অবস্থান করে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহ তাঁর মনের আশা পূর্ণ করবেন বলে তিনি জানান।