এশিয়ার বৃহৎত্তম কাপ্তাই হ্রদের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন শেষে নতুন করে জাল নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় হ্রদে জাল ফেলতে অপারগতা জানিয়েছেন জেলেরা। সরকারের বেঁধে দেয়া ৭শত ফুট লম্বা ২৫ ফুট গভীরতায় নিয়মে হ্রদে জাল ফেললে মাছ আহরণ কখনোই সম্ভব হবে না বলে জানান জেলেরা। তাই সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম তুলে নেয়া অথবা পরিবর্তন করার দাবী জানিয়েছেন জেলেরা।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলেরা যদি হ্রদে না নামে তাহলে আমরা ব্যবসা করতে পারবো না। তাই ব্যবসায়ীরাও হ্রদের জালের বিষয়ে কিছুটা পরিবর্তন করার আহবান জানান ব্যবাসয়ীরা। অন্যদিকে মৎস্য গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আজহার বলেন, কাপ্তাই হ্রদ বাঁচাতে হলে এই মাপের জাল ব্যবহার করলে হ্রদের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। নইলে আগের নিয়মে যদি জাল ফেলে হ্রদ ধ্বংস হয়ে যাবে।
এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের মাছ আহরণের সময়সীমা বৃদ্ধির দাবি জেলেদের। কেচকি মাছ আহরণ নিয়ে বিপাকে কাপ্তাই হ্রদের জেলেরা। প্রতি বছরএ সময় কাপ্তাই হ্রদ পানিতে ভরপুর হয়ে থাকে। কিন্তু এবছর হ্রদে এখনো পর্যাপ্ত পরিমান না হওয়াতে হ্রদে মাছ আহরণ আরো ১মাস বৃদ্ধি করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবরে লিখিত আবেদন দিয়েছেন কেচকি জাল সমিতি। বিষয়টি সদয় অবগতির জন্য প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও ব্যবস্থাপক, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ আরো অন্যান্য সরকারী দপ্তরে লিখিত ভাবে আবেদন করা হয়েছে।
কাপ্তাই হ্রদের জেলে ও কেচকি জাল সমিতির সভাপতি উপসেন দাশ বলেন, হ্রদ কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে জেলেদের উপর যে নতুন নিয়ম আরোপ করতে যাচ্ছেন তাতে আমরা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারবো না। তার কারণ হলো বর্তমানে আড়াই হাজার ফুট বাই ৭০ ফুট গভীরতায় হ্রদে মাছ পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর সরকারের নিয়মে ৭শত ফুট লম্বা ২৫ ফুট গভীরতায় মাছ পাওয়ার কোন ভাবেই সম্ভাবনা নেই। হ্রদ বেষ্টিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে কারণে এই নতুন নিয়ম করতে যাচ্ছে সেটা হলো তারা মনে করে কেচকি জাল দিয়ে জেলেরা হ্রদের সব মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা।
তিনি আরো বলেন, এ নতুন নিয়ম যদি চালু করা হয় তাহলে এবছর কোন জেলেই হ্রদে মাছ আহরণে নামবেন না। হ্রদের উপর নির্ভরশীল জেলেরা প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। তার পরও নতুন নিয়মে তারা হ্রদে মাছ আহরণে যাবে না। কোভিড-১৯ সংক্রমণে কাপ্তাই হ্রদের জেলেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। তার মধ্যে আবার নতুন দিক নির্দেশনা। জেলেদের পক্ষ হতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন বিষয়টি বিবেচনা পূর্বক প্রত্যাহার করা হউক।
কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা জেলে কালিপদ দাশ বলেন, হ্রদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ বছর পরে যদি কেচকি জাল নিয়ে নতুন নিয়ম কানুন বেঁধে দেন তাহলে আমরা জেলেরা বাঁচব কি ভাবে। বর্তমানে ২২শ’ ফুট লম্বা ও ৭০ ফুট গভীরতার জাল দিয়ে মাছ ধরা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর ৭শত ফুট লম্বা ২৫ ফুট গভীরতার জাল দিয়েতো মোটেই মাছ ধরা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, রাঙ্গামাটি জেলায় প্রায় ২-৩ হাজার জেলে রয়েছে। সবাই হ্রদের মাছ আহরণের উপর নির্ভরশীল। আর আমরা যারা কেচকি জাল দিয়ে মাছ আহরণ করি সবার বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। অপরদিকে অনেক জেলের সওদাগরের কাছ থেকে মাছের উপর অগ্রিম অর্থ নেওয়া আছে। যার পরিমান ২ লক্ষ হতে শুরু করে ১০লক্ষ টাকা পর্যন্ত। গত বছর এই সময়ে হ্রদে প্রচুর পানি ছিল কম বেশী মাছ আহরণ করা গেছে। কিন্তু এ বছর এখনও হ্রদে নামতে পারিনি আমরা। হ্রদে পানি না থাকায় মাছ আহরণ আরও একমাস পিছিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করেছি।
আরেক জেলে আবদুল মুনাফ বলেন, প্রাণি সম্পদ ও মৎস্য মন্ত্রনালয় কাপ্তাই হ্রদের জেলেদের মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে যে নতুন নিয়মে আদেশ জারি করে বিএফডিসি কমান্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা সংস্থার কাছে অনুলিপি দিয়েছেন তাতে চরম ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি আমরা। জেলেরা মাছ ধরতে হ্রদে নামার সাথে সাথে প্রশাসনের লোকজনের সাথে একটি দন্ড সৃষ্টি হবে। যার জন্য নতুন নিয়মে আমরা এ বছর হ্রদে মাছ আহরণে নামব না। তবে হ্রদের জেলের পরিবার পরিজনের দায় দায়িত্ব বহন করতে হবে সরকারকে। আর হ্রদে মাছ আহরণে জেলেরা না নামলে হ্রদের ছোট মাছ আহরণে বিশাল রাজস্ব হারাবে সরকার। এটার দায়ভার কে বহন করবে?
এদিকে কাপ্তাই হ্রদ বৃহত্তর মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি কবির আহম্মদ ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ শুক্কুর বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত আমরা মানতে রাজি আছি। তবে আমরা জেলেদেরকে কোন ভাবেই বোঝাতে পারছি না। জেলেরা যদি হ্রদে নামে তাহলে আমাদের কোন সমস্যা নেই। জেলেরা যদি হ্রদে না নামে তা হলে আমরা কিভাবে ব্যবসা করবো। তাই সকলের স্বার্থে ও কাপ্তাই হ্রদ বাঁচাতে সিদ্ধান্তের কিছুটা পরিবর্তন করার আহবান জানান তারা।
মৎস্য বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী বলেন, কাপ্তাই হ্রদ দখল করে আছে কিছু মাছ ব্যবসায়ি। জেলেরা হলো বলির পাঠা। আর যে সকল জেলে হ্রদে মাছ আহরণ করতে আসে তারা সবাই রাঙ্গামাটির বাইরের লোক। কেন তারা কার্ড পাবে। তিনি বলেন, কেচকি জাল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তার পরও বিশেষ বিবেচনায় জেলেদের প্রতি দরদ দেখিয়ে শর্তদিয়ে কেচকি জাল অনুমতি দিয়েছেন। কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে হাই প্রোফাইল ১৫-২০ আন্তঃ মিটিং করা হয়েছে। ওই মিটিং এ এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাপ্তাই হ্রদ বাঁচানো সকলের দায়িত্ব রয়েছে। কেচকি জাল দিয়ে মাছ আহরণ করতে গিয়ে ৩০-৩৫ ধরনের কার্প প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। এতে করে দিন দিন কাপ্তাই হ্রদে মাছের বংশ বিস্তার কমে যাচ্ছে এবং আগের তুলনায় হ্রদ থেকে অনেক মাছ বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। তাই এইসব কথা বিবেচনা করে কাপ্তাই হ্রদের জেলেদের মাছের জালের উপর কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে যাচ্ছে।