রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের শিয়ালী গ্রামে অনাকাঙ্খিত ঘটনার দিন থেকে এ পর্যন্ত সেই মসজিদটিতে ওয়াক্ত মত আযান ও নামাজ হচ্ছে-না। ইমাম, মুসল্লী ও এলাকার লোকজনের বিরূদ্ধে মামলা হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানায়। ওই এলাকার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন যাদের বিরূদ্ধে মামলা হয়নি তাদেরকেও মামলায় ধরিয়ে দেয়ার ভয়-ভীতি দেয়া হচ্ছে। ভয়ে-আতংকে ও উৎকন্ঠায় দিনযাপন করছে এলাকার সাধারণ মানুষ। ঘটনার পর এলাকায় খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ভারতীয় হাই কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপারসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং এলাকায় র্যাব ও দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মামলার সূত্র ধরে, রোববার রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটকের পর আদালতে প্রেরণ করে সাত দিনের রিমান্ড চায়। ওই দিন রিমান্ড না দিয়ে আদালত শুনানীর দিন ধার্য করে তাদের কারাগারে পাঠান। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে আদালত মঙ্গলবার আসামিদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে এলাকাবাসী, মামলার এজাহার ও অনুসন্ধানী তথ্য মতে জানা গেছে, শিয়ালী পূর্ব পাড়া গ্রামের একজন হিন্দু ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে শিয়ালী মহাশশ্মানে তিনদিন ভগমানের নামে পূজা করিলে কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) মুক্তি লাভ করিবে। সেই আশায় গত ৬ আগস্ট আনুমানিক রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ঘাটভোগ ইউনিয়নের শিয়ালী পূর্ব পাড়া গ্রামে হিন্দু ধর্মালম্বী পূরুষ ও মহিলারা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে হরিকীর্ত্তন গান গাইতে গাইতে শিয়ালী মহাশশ্মানের দিকে যাওয়ার পথে ওই মসজিদের সামনে রাস্তায় পৌছালে এশার নামাজের জন্য থাকা ইমাম মো. নাজিম মসজিদ থেকে বের হয়ে এসে বলে এখন নামাজের সময় ঢাক-ঢোল বন্ধ সহ হরিকীর্ত্তন গান গাইতে নিষেধ করে। তখন উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডায় শুরু হয়। তার কিছুক্ষণ পর সংবাদ পেয়ে সাথে সাথে শিয়ালী ক্যাম্প ও রূপসা থানা পুলিশ ঘটনা স্থল এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে এ স্বপ্ন দেখার বিষয়টিকে ঘিরে এলাকার সাধারণ মানুষ হাস্যকর হিসেবে মনে করেছেন। উল্লিখিত ঘটনার পর ওই এলাকায় মসজিদে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, কয়েকটি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে মূর্তি ভাংচুর সহ দোকান ভাংচুর এবং হামলার ঘটনায় থানায় মামলা হওয়ার পর পুলিশ ১০ জনকে আটক করেছেন। খুলনা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ৩-এর বিচারক মো. সাইফুজ্জামান মঙ্গলবার দুই দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন।
আদালত সূত্র জনায়, গত শনিবার সন্ধ্যায় চাঁদপুর, শিয়ালী গ্রামসহ আশপাশ গ্রামের কিছু লোক একত্র হয়ে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে বাড়িঘর ভাংচুর করে। এ সময় তাদের ঘরের মালামাল লুট করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। একপর্যায়ে তারা মহাশশ্মান মন্দির, পূর্ব পাড়া সার্বজনীন মন্দির ও মন্দিরের ভেতরের কিছু মুর্তি ভাংচুর করে। এ ঘটনায় পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শক্তিপদ বসু বাদী হয়ে রূপসা থানায় মামলা দাখিল করেন। পরেরদিন রোববার রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটকের পর আদালতে প্রেরণ করে। উল্লেখ্য শিয়ালি গ্রামের পূর্ব পাড়া মসজিদের ইমাম নাজিমকে লাঞ্চিত, মসজিদের ভিতরে থাকা মুসাল্লিদের ইট নিক্ষেপ ও হাতা হাতির ঘটনা ঘটে ৬ আগস্ট রাতে এশার নামাজের সময়। একদিন পর মন্দির এবং কিছু দোকান ভাংচুরের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়।
ঘটনার পর এলাকায় জেলা পুলিশ সুপার সহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং এলাকায় র্যাব ও দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মসজিদের ইমাম নাজিম সমাদ্দার জানান, গত ৫ আগস্ট মসজিদের সামনে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫/৩০ জন পুরুষ/মহিলা ঢোল ও উলু দিয়ে নাম কীর্তন করতে করতে মন্দিরের দিকে যায়। ঢোল ও উলুর উচ্চ শব্দের কারণে মসজিদে এশার নামাজের বিঘিœত সৃষ্টি হয়। গত ৬ আগস্ট এশার নামাজের সময় তারা আবারও ঢোল ও উলু দিয়ে মসজিদের সামনে উচ্চ শব্দে কিছু সময় ধরে বাজাতে থাকে। তখন ইমাম তাদের কাছে গিয়ে বলেন, ভাই মসজিদে নামাজ চলছে, এখান থেকে একটু সামনে গিয়ে বাজান। এই কথা শুনে শিব ধর নামে এক ব্যক্তি আমাকে গলা ধাক্কা দেয় এবং বলে মসজিদ এখানে রাখা যাবে না। এ সময় ৬/৭ জন মুসাল্লিদের সাথে ২৫/৩০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের কথা কাটাকাটি হয় এবং মসজিদে ইট নিক্ষেপ শুরু করে। এর আগে মাসুম নামে এক যুবক মসজিদের কাছে ঢোল না বাজানোর জন্য তাদেরকে অনুরোধ করলে তাকেও মারতে আসে। পরবর্তীতে ৭ আগস্ট বিকালে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় রূপসা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বাদশাকে আহ্বায়ক করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বর্তমানে ওই এলাকায় মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন