মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন হলেও ৯মাসেও নির্মাণ শুরু হয়নি। মূলত নির্ধারিত স্থানে প্রাচীর ও কাটা তারের ঘেরা-বেড়ায় আটকা পড়ে গেছে এর সামগ্রিক কার্যক্রম কপোতাক্ষ নদ চরভরাটি সরকারি খাসজমি। গত বছর ৯ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষযক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। এর কয়েক দিন পর জায়গাটি নিজেদের মালিকানাধীন দাবি করে সেখানে প্রাচীর ও কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নেয় স্থানীয় অমিত ও অভিজিত সাধু গং। এ ছাড়া পাশে প্রাচীর দিয়ে অবৈধভাবে দখল নেয় এক দরিদ্র পরিবারের ক্রয়কৃত রেকর্ডীয় সম্পত্তি। বহুলালোচিত জায়গাটি বে-দখলের খবরে গত ১৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তৎকালীণ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলমের নেতৃত্বে কাটাতারের বেড়া অপসারণপূর্বক ঐ সম্পত্তির অবৈধ দখলমুক্ত করা হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও দখল করা হয়েছে বলে মেীখিকভাবে সাংবাদিকদের জানান। প্রভাবশালী ভূমিদস্যু অভিজিত সাধু অবৈধ দখল থেকে যায় এ দরিদ্র পরিবারের ক্রয়কৃত রেকর্ডী সম্পত্তি। যা নাছিরপুর মৌজা এস.এ খতিয়ান ১৯৩, দাগ ৪২৬/৫৯৩। এর আগে গত ৯ডিসেম্বর’২০ ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবসে নদ ভরাটী জমিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন। তারও আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলম, স্থানীয় ইউএলএও হাসমত, উপজেলা সার্ভেয়ার মো. কাওছার আলীসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থেকে কমপ্লেক্সের স্থান নির্ধারণ ও জরিপকার্য সম্পন্ন করেন। তবে সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলমের বদলিকালীন সময়ে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ভ্রাতা কুঞ্জবিহারী সাধুর ওয়ারেশরা ফের ঐ সম্পত্তি তাদের বলে দাবি করে পুনরায় কাটাতারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নিয়েছে। কুঞ্জবিহারীর বড় ছেলে নারায়ন সাধু ভারতে অবস্থান করায় দেশে ৪পুত্র ওয়ারেশ দাবী করে বড় সৎ ভায়ের জমি আত্মসাৎ করছে। এমন পরিস্থিতিতে কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, ২০১৩সালে কপোতাক্ষের চরভরাটি নাছিরপুর মৌজার খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগের বিস্তীর্ণ সম্পত্তির মধ্য থেকে স্থানীয় জনৈকা মালঞ্চ নামের এক গৃহ ও ভূমিহীন মহিলা মিস কেস নং-৮৭৬/১২-১৩ মাধ্যমে ১০শতক খাসজমির ডিসিআর প্রাপ্ত হন। তবে বরাবরই ডিসিআর প্রাপ্ত হয়েও ঐ সম্পত্তি দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা-পাল্টা মামলারও ঘটনা ঘটে। বিষয়টি অবহিতপূর্বক তখন ওই মহিলার জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐবছরে তিনি ৩০জানুয়ারি ২০১৮, ০৫.৪৪.৪৭০০.০৩১.৩৩.০০১.১৮-১৪৫৫নং স্মারকে দখল ও সীমানা বুঝে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাইকগাছাকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মহিলা বন্দোবস্তকৃত সম্পত্তির দখল নিতে গেলেও বাঁধার মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হন। এরপর সর্বশেষ গত বছরের ৫মে পুনর্দখল বুঝে পেতে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি আবেদন করলে ইউএনও ৬মে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে কপিলমুনি ভূমি অফিসের ইউএলও এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাবুল হোসেনকে নির্দেশ দেন। যার প্রাপ্তি নং-২৯৪। সর্বশেষ ইউএনও অনুমতিতে স্থানীয় ইউএলও-স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় ১৪মে সকালে কপোতাক্ষ তীরের বন্দোবস্তপ্রাপ্ত খাসজমিতে তৃতীয় দফায় ঘর বাঁধতে গিয়েও দখলদারদের বাধার সম্মুখীন হন। ঐ ঘটনায় ১৬মে পাইকগাছা বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্থানীয় দখলদারদের একজন তপন কুমার সাধুর ছেলে অমিত সাধু ওরফে শান্ত বাদী হয়ে স্থানীয় ইউএলএও মো. জাকির হোসেন ও স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেন। যা পিবিআিই তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যর মধ্যস্থতায় মহিলাকে অন্যত্র পূণর্বাসন করলে ফের ঐ সম্পত্তির দখলে যান অমিত ওরফে শান্ত সাধু গং। এরপর কপিলমুনি মুক্ত দিবসকে সামনে রেখে সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিলে নড়ে চড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রশাসনের দফায় দফায় বৈঠকে ঐএলাকা নির্ধারিত স্থান বলে চিহ্নিত ও কয়েক দফায় সার্ভেয়াররা জরিপ করে সীমানায় লাল পতাকা টানিয়ে দেন। এরপর ৯ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। তবে এরপরও বন্ধ হয়নি এর দখল কার্যক্রম। সম্প্রতি তারা ফের দরিদ্র পরিবারে ব্যক্তিগত ও সারকারি খাস ভিত্তিপ্রস্তরসহ গোটা এলাকায় কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নিয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ’৮০-এর দশক থেকে প্রথমে কপোতাক্ষের ব্যাপক ভাঙন ও পরবর্তী পর্যায়ে নাব্যতা হ্রাসে কপিলমুনি সদরের কপোতাক্ষের তীর জুড়ে গড়ে ওঠে বিস্তীর্ণ চরভরাটি খাসজমি, যা সরকারের সর্বশেষ মানচিত্রে ১নম্বর খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগে চিহ্নিত হয়। দাগের পাশেই এস.এ ১৯৩ খতিয়ানে ৪২৫, ৪২৬/৫৯৩ দাগে ননীবালা অধিকারী জমি এবং এস.এ ১৯২ খতিয়ানে ভিপি “ক” তালিকাভূক্ত ০.৪৮ একর জমি। নদের নাব্যতা হ্রাসে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ হয়ে বর্ষা মৌসুমে স্থায়ী জলাবদ্ধতা ও জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলনের মুখে সরকার কপোতাক্ষ নদ খননের কাজ শুরু করে। ওই সময় খননকৃত মাটি দুই পাড়ে ফেলায় কপিলমুনি অংশে দৃশ্যমান হয় বিস্তীর্ণ খাস জমির। আর সেই সুযোগে শুরু হয় প্রভাবশালীদের দখলপ্রক্রিয়াও। প্রসঙ্গত, ১৯৭১সালের ৯ডিসেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলো দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান রাজাকার ঘাঁটির রাজাকাররা। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন ১৫৫জন রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে। রাজাকার ঘাঁটি (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংসের পথে) থেকে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন কাগজপত্রের সাথে পাওয়া যায় রাজাকারদের হাতে লেখা এক হাজার ৬০১জন শহীদের তালিকা। রাজাকারদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে এলাকার আরো ১হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের তালিকা পাওয়া যায়। ক্যাম্প থেকে এদিন দেয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজী নামে এক মুক্তিযোদ্ধার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আত্মসমর্পণের খবরে সহচরী বিদ্যা মন্দির স্কুল মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের গণআদালতে এদিন ১৫১জন রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীণ গণআদালতের রায়ে এক সঙ্গে এত সংখ্যক রাজাকারের শাস্তির সম্ভবত এটাই একমাত্র ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপুঞ্জ অবগত হওয়ার পর সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর ২০’ কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ঐ অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সচিব ইউসুফ হারুন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলমসহ সরকারি, বে-সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের নের্তৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তবে এরপরও ভিত্তিপ্রস্তরসহ গোটা এলাকায় প্রাচীর আর কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলের ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধের কমপ্লেক্স নির্মাণে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। যদিও প্রশাসনের পক্ষে বলা হচ্ছে, যথা সময়ে সম্পূর্ণ সরকারি জমিতেই নির্মিত হবে মক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স। কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার ফারুখ আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় কতিপয় মহলের ইন্ধনে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকৃত নির্ধারিত স্থানে কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দেয়া হয়েছে। এনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এমপি, ইউএনওসহ সকলের সাথে কথা হয়েছে। সময় হলে বেড়া উচ্ছেদ করা হবে। কপিলমুনি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউএলএও মো. সবুর হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স ভবনের ভিত্তিপ্রস্তরের নির্ধারিত স্থানেই সেটি হবে। এ ছাড়া কমপ্লেক্স ভবন বাস্তবায়নে সরকারি জায়গায় সংকুলান হবেনা। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন কিছু জমি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে পেছনের মালিকপক্ষ দাবি করেছে তাদের বেরোনোর পথ দিলে তারা মালিকানাধীন প্রয়োজনীয় সম্পত্তি ছেড়ে দেবেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স শত ভাগ খাস জায়গায় নির্মিত হচ্ছে। সুতরাং ব্যক্তি বিশেষ এই জায়গা দখলের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।